ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সেচ মৌসুমের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ে প্রচণ্ড গরম পড়ে, বিদ্যুতের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। জ্বালানি সংকটে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে অতিরিক্ত গরমের কারণে যন্ত্রাংশ গরম হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধও রাখতে হয়। ফলে সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর এবারে সেই চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে দেবে বিদ্যুতের বাড়তি দাম।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, এবার সেচের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই হাজার ৩৯৫ দশমিক ২৭৭ মেগাওয়াট। সারাদেশে চার লাখ ৬৫ হাজার ৪৫৯টি সেচ সংযোগে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে তৎপর রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষককে পরিশোধ করতে হবে বিদ্যুতের বাড়তি দাম। এতে পন্যের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়বেন ভোক্তারা।
সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ায় সরকার। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এই আদেশে বাড়তি দাম চলতি জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। অন্যান্য বার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কৃষি বা প্রান্তিক দরিদ্র গ্রাহকদের বিবেচনায় নানা ধরনের সুবিধা রাখলেও নির্বাহী আদেশে সেই সুবিধা রাখা হয়নি। সবশ্রেণির গ্রাহকদের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আবাসিক গ্রাহক ছাড়াও বেড়েছে সব ধরনের বিদ্যুতের দাম। ফলে কৃষি উৎপাদনে খরচ বাড়বে, যা কৃষি উৎপাদনের প্রভাব ফেলবে।
বিশ^ব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে জানিয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশকেও তা খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, এমনিতেই নানা উপকরণের দাম বাড়ায় কৃষক ফসল উৎপাদনে উৎসাহ হারাচ্ছেন। এ অবস্থায় সেচকাজে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন কৃষকদের জন্য আলাদা ভাবা দরকার। তাদের এখন দরকার নগদ আর্থিক সহায়তা।
এদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। যদি আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ে, তখন অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে আরও চাপে থাকবে কৃষক।
সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে চলতি সপ্তাহে একটি বৈঠক হয়েছে। এতে ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বৈঠকসূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে প্রতিদিন এক হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, ৭৭ হাজার টন তেল এবং ৬৬ হাজার টন ডিজেলের চাহিদা নির্ধারণ করেছে পিডিবি। সেচে মোট চাহিদা দুই হাজার ৩৯৫ মেগাওয়াটের মধ্যে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এককভাবে দুই হাজার ২৮ মেগাওয়াট, পিডিবি ১৭১ মেগাওয়াট, নেসকো ১৪৪ মেগাওয়াট এবং ওজোপাডিকো ৫০ মেগাওয়াট বিতরণ করবে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এ বছর সেচকালেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ করা বাস্তবতার আলোকে সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। এ কর্মকর্তা বলেন, গত বছরও পিডিবি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য গ্যাসের চাহিদা দিয়েছিল প্রতিদিন ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ করা হয়েছে সর্বোচ্চ এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ বছরও হয়তো চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কিছু বাড়বে। তবে সেটি চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা কঠিন। ফলে লোডশেডিং করেই সেচ মৌসুম পার করতে হবে। সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নিলেও তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান এ কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, এবার গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্ভর করা হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর। অথচ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহের কোনো যৌক্তিক নিশ্চয়তা নেই।
এদিকে শুধু বিদ্যুৎ নয়, গত ১৭ জানুয়ারি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। খাতওয়ারি এক লাফে ১৪ থেকে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। নির্ধারিত নতুন দাম ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। আবাসিক খাতে, সার ও চা উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস ছাড়া অন্য খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বেড়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাবও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর পড়বে।