দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। অথচ রোগটি নিয়ে অভিভাবকদের মাঝে নেই কাঙ্ক্ষিত সচেতনতা। বছরজুড়েই নিউমোনিয়ার সংক্রমণ থাকলেও শীতকালে দেখা দেয় প্রকোপ। আর তাই এই সময়ে শিশুর যত্নে বাড়তি সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে কৃত্রিম অক্সিজেনে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ছোট্ট শিশুটি
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে কৃত্রিম অক্সিজেনে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ছোট্ট শিশুটি
রাশেদ বাপ্পী
সরেজমিনে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এনআইসিইউ) গিয়ে দেখা যায়, ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারানো একটি শিশু কৃত্রিম অক্সিজেনে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার প্রাণান্তর চেষ্টা করছে। ৩৮ বেডের এনআইসিইউর শয্যার ২২টিতেই ভর্তি নিউমোনিয়ার রোগী। জটিলতাও যাদের অনেক বেশি।
ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ নিউমোনিয়া মূলত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক কিংবা অন্য যে কোনো পরজীবীর সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। রোগটি ফুসফুসকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করায় শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। যার কারণে ক্ষতিকর কার্বন ডাইঅক্সাইড শরীরে জমা হয়ে দ্রুত মস্তিস্ক, হৃৎপিণ্ড, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত করে রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে নিউমোনিয়ার। কারণ হিসেবে অপর্যাপ্ত-দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং আগে থেকেই নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা।
বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেসপিরেটারি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাছুম আহমেদ বলেন, যাদের আগে থেকে ঠান্ডার সমস্যা আছে তাদের নিউমোনিয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এটি যে কোনো বয়সে হতে পারে, তবে কম বয়স এবং বেশি বয়সে এই রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
আইসিডিডিআর,বির দেয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতি হাজারে ৩৬১ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। পাঁচ বছরের কম বয়সে মারা যাওয়া শিশুদের প্রতি পাঁচটির মধ্যে একটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত, যা শতকরা হিসাবে ২০টি।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দশক ধরে বাংলাদেশের মতো মধ্যম ও স্বল্প আয়ের দেশে শিশুমৃত্যুর প্রথম কারণ নিউমোনিয়া। শিশুর শ্বাসকষ্ট, জ্বর-কাশি, শ্বাসের সময় বুক ভেতরের দিকে দেবে যাওয়া ইত্যাদি নিউমোনিয়ার লক্ষণ। শীতকালে এ রোগের প্রকোপ বাড়ার আশংকা থাকে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম এ বছর শিশুদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি দেখতে পাচ্ছেন। তিনি জানান, গত বছর ২ হাজার ২২৭ শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হলেও চলতি বছরে বুধবার পর্যন্ত ২ হাজার ৪৩৪ শিশু ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৫টির মৃত্যু হয়েছে। চলতি নভেম্বরের প্রথম ৯ দিনে ৮৪ শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছে।
উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণ ও অনিরাপদ পানি পানের ফলেও শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বলেও জানান ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম। বলেন, শিশু জন্মের পর ৬ মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ এবং পরে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। এ ছাড়া পাশাপাশি সময়মতো টিকা দিলে এ ঝুঁকি কমে।
নিউমোনিয়া থেকে বাঁচতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের পাশাপাশি টিকা গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ৯৩ লাখ ৫০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। আর দিনে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৫০০ শিশুর মৃত্যু হয়। নিউমোনিয়ায় ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে ৫৪ শতাংশ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসা হলেও বাংলাদেশে এই সংখ্যা ৩৭ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় লাখ মানুষ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে পাঁচ বছর বয়সের আগে প্রায় ২০ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটে।