বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে যারা ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডস লিমিটেডের শেয়ার কিনেছিলেন, তাদের সেই স্বপ্ন পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছেন খোদ প্রতিষ্ঠানটিরই শীর্ষ কর্মকর্তা এমএ খালেক। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লুটে নিয়েছেন ৫১৬ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরও চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে এমএ খালেকের ২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিষয়েও তদন্ত করছে একাধিক সংস্থা। এ কা-ে খালেকের পরিবারসহ ৫২ সহযোগীর খোঁজ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের মধ্যে ৪৬ জনের ব্যাংক হিসাব সম্প্রতি তলব করা হয়েছে।
লুট করা এই বিপুল পরিমাণ অর্থে খালেকের স্ত্রী-সন্তান কানাডায় বাড়ি কিনে সেখানে বসত গড়েছেন। ফারইস্টের সাবেক চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের কানাডা-আমেরিকায় বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে সিআইডি ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডসের গ্রাহকদের বিপুল অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করছে সিআইডি। সিআইডির অনুসন্ধান কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডস লিমিটেডের চেয়ারম্যানের পদে থেকে এমএ খালেক নামে-বেনামে বিভিন্ন কৌশলে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। সিআইডি এ পর্যন্ত খালেক, তার পরিবার ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৫১৬ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কৌশলে প্রতিষ্ঠান থেকে এসব টাকা সরিয়ে নেওয়া হয় যার একটি বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে দেশের বাইরে।
অনুসন্ধান কর্মকর্তা আরও বলেন, ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডস লিমিটেড ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, প্রাইম ফাইন্যান্সিয়াল লিমিটেড ও প্রাইম এশিয়া লিমিটেড থেকে একই প্রক্রিয়ায় আরও প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে খালেকচক্র। এসব টাকায় কানাডায় সেকেন্ড হোম গড়েছে খালেকের পরিবার। তার স্ত্রী-সন্তানরা ইতোমধ্যেই কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। তিনিও সেখানে পালিয়ে যেতে পারেন।
এমএ খালেক চেয়ারম্যান থাকাকালে কোনো রকম অর্থ পরিশোধ না করেই তার পরিবারের সদস্য ও সহযোগীদের বিও অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা জমা দেখিয়ে চলত লুটপাট। খালেকের নির্দেশে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এসব টাকা জমা করতেন। এর পর সেই টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হতো। এভাবে ১০ বছরে ৫১৬ কোটি টাকা সরিয়েছে খালেকচক্র। কোম্পানির তৎকালীন সিইও তরফদার জাহাঙ্গীর আলমসহ কিছু কর্মকর্তা মোটা টাকার বিনিময়ে চেয়ারম্যান খালেকের এ অপকর্মে সহযোগিতা করতেন।
আমাদের সময়ের হাতে আসা ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডস লিমিটেডের লেনদেন ও ব্যাংক হিসাব থেকে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান খালেক তার স্ত্রী সাবিনা খালেক, ছেলে শাহরিয়ার খালেক, মেয়ে শরৎ খালেক, মেয়ের জামাই তানভীর হক, তানভীর হকের বাবা ফজলুল হকসহ তার আত্মীয়স্বজন এবং সহযোগীদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ লুটপাট করেছেন। এর মধ্যে একটি হিসাবেই দেখা যায়, বিও অ্যাকাউন্টে ২৫ কোটি ১০ লাখ টাকার ভুয়া ডিপোজিট দেখিয়ে নগদ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বজন ছাড়াও খালেক তার সহযোগীদের বিও অ্যাকাউন্টে ভুয়া ডিপোজিট দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন। আত্মসাৎকৃত এ টাকার একটি অংশ তিনি সহযোগীদের মধ্যে বাটোয়ারা করে দিতেন। খালেকের এমন ১৯ সহযোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তারা হলেন- গোলাম কিবরিয়া, হাবিবুর রহমান, সিরাজুস সালেহীন, আসিফ বিনদোজা, সুলাইমান রুবেল, সাইফুল ইসলাম, আল ফিরোজ হোসেন, মোয়াজ্জেম হোসেন, কামাল শিকদার, আল ফিরোজ হোসাইন, আমির হোসাইন, মিজানুর রহমান মোস্তফা, জামাল উদ্দিন, পরিতোষ কুমার সাহা, ফেরদৌস ইসলাম সাগর, কামরুল ইসলাম, রেজাউল করিম, মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান ও সেলিমুল আলম।
জানা গেছে, কৌশলে কিছু ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে এর বিপরীতে ভুয়া বিও অ্যাকাউন্ট খুলে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন খালেক। যাদের পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকে বিষয়টি জানতেনই না। এমনই একজন তাজুল ইসলাম। তার নামে খোলা বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৭১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন খালেক। তাজুল বিস্ময়ের সঙ্গে জানান, তিনি ওই বিও অ্যাকাউন্টের বিষয়ে কিছুই জানেন না।
সিআইডি বলছে, খালেকের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের সাবেক সিইও তরফদার জাহাঙ্গীর আলমের শ্যালক এসকে ইউসুফ আলী ২০১৪ সালে দুই দফায় তুলে নিয়েছেন ৮ কোটি ২৭ লাখ (১৯ আগস্ট) এবং ১৩ কোটি ৯২ লাখ (২৫ আগস্ট) টাকা। একই মাসের ২৪ আগস্ট জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী খুশরুবা সুলতানা ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং ২১ আগস্ট খালেকের শ্যালিকা দিলরুবা সুলতানা নিয়েছেন ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
অপকর্মে আরও উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা শামীম আলম মামুন, জাহিদুল হক, জাহিদুল কবির, তামজীদ খান, একেএম কামরুজ্জামান ও রুহুল আমিনের নাম। এ ছাড়া অপকর্মে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন এসএভিপি জাকির হোসেন ভুইয়া ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ত্রিপোতি মণ্ডল ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডসের লুটপাটে খালেক, প্রতিষ্ঠানের আরেক সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, সিইও তরফদার জাহাঙ্গীর আলমসহ তাদের নিকট আত্মীয় ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্তত ৫২ জনের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন সংস্থায় পাঠানো হয়েছিল। অনুসন্ধানে অর্থ আত্মসাতে তাদের প্রাথমিক সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হয়েছে। এখন তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে তরফদার জাহাঙ্গীর আলম আমাদের সময়কে বলেন, সিআইডিকে আমার লিখিত বক্তব্য জানিয়েছি। শেয়ারবাজারে ধস এবং করোনার কারণে প্রতিষ্ঠান অনেক টাকা লোকসান করেছে। সেই কারণে প্রতিষ্ঠানের অবস্থা নাজুক হয়েছিল। ভুয়া বিও অ্যাকাউন্ট দিয়ে যে অর্থ তুলে নেওয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে সেটাও সঠিক না বলে দাবি করেন তিনি। জানান, তার সময়ে প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো অর্থ আত্মসাৎ কিংবা পাচারের ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে, ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান ও সাবেক ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৮১৬ কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব অর্থের একটা বড় অংশ খালেক ও তার সহযোগী নজরুল ইসলামসহ অন্যরা দেশের বাইরে পাচার করে বাড়ি-গাড়ি ও ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। কোম্পানির লিগ্যাল অফিসারের দায়ের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, সাবেক পরিচালক এমএ খালেক ও খালেকের ছেলে রুবায়ত খালেককে গত ১৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে শাহবাগ থানা পুলিশ।
দুদক জানিয়েছে, খালেকের সহযোগী নজরুল ইসলাম, কোম্পানির সাবেক সব পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্লাহ এবং কোম্পানির কিছু শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাও অর্থ আত্মসাতের এ কা- ঘটান। খালেকের অন্যতম সহযোগী নজরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। নজরুলেরর ছেলেমেয়ের নামে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি কোম্পানি।