মাঠপ্রশাসন কর্মকর্তাদের আচরণে বিব্রত সরকার

Slider জাতীয়


বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহরুবা ইসলাম ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতার ট্রফি ভেঙে ফেলে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেন, যে ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। বগুড়ায় ইউএনও সমর পালের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেনকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। এর আগে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বর্তমান সরকার আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য সবার কাছে দোয়া চান, যার ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে পটুয়াখালীর গলাচিপা, কক্সবাজারের টেকনাফ, ফরিদপুরের বোয়ালমারী ও নওগাঁর বদলগাছীসহ আরও কয়েকটি স্থানে মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের আচরণে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের এ ধরনের আচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

গত শুক্রবার বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার চৈক্ষ্যং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে স্থানীয় সংগঠন আবাসিক যুব স্বাধীন সমাজ ক্লাব। এতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউএনও মেহরুবা ইসলাম। খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণের আগে তিনি দুই দলের বিতর্ককে কেন্দ্র করে ট্রফি দুটি আছড়ে ভেঙে ফেলেন। এতে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় গতকাল রবিবার সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে সাংবাদিকরা কথা বলতে চাইলে তিনি অপরাগতা প্রকাশ করেন। এরপর মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আলীকদমে ট্রফি ভেঙে ফেলার ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে মেহরুবা ইসলাম দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর আগেও প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার কর্মকা- নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। সর্বশেষ আলীকদমের ইউএনও এমন ঘটনা ঘটালেন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অতিরিক্ত সচিব বলেন, বান্দারবানসহ কুড়িগ্রামের প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ও বগুড়ার ঘটনার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। এরই মধ্যে প্রত্যেকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনের পর যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত বৃহস্পতিবার বগুড়া সদরের ইউএনও সমর পালের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেনকে লাঠি দিয়ে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া চলমান এসএসসি পরীক্ষায় পটুয়াখালীর গলাচিপায় খারিজ্জমা ইসহাক মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষা শুরুর ১০ মিনিটের মধ্যে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার মো. ইসমাইল রহমান ৯ পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে সমালোচনায় আসেন।

গত ২১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে উপহারের ঘর নির্মাণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে স্থানীয় সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কায়সার খসরু। এ ঘটনার একটি অডিও প্রকাশ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ঘটনার তিন দিন পর ওই ইউএনওকে ওএসডি করা হয়। সাংবাদিকের সঙ্গে ইউএনওর ভাষা ব্যবহারকে ‘মাস্তানদের চেয়েও খারাপ ভাষা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি নোটিশ জারি করতে যাওয়া আদালতের দুই কর্মচারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ইউএনওকে হাইকোর্টে তলব করা হয়। গত বছরের ৪ জানুয়ারি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করারও অভিযোগ ওঠে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানজনকভাবে নাম ধরে ডাকা, সরকারি ত্রাণের কম্বল দেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশসহ ইউএনওর বিভিন্ন অশালীন আচরণের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

গত বছরের আগস্টে লালমনিরহাটের আদিতমারীর ইউএনও মুনসুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে স্থানীয় দুজনকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে নালা তৈরিতে আপত্তি জানালে ইউএনও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার’ কথা জানানোর পাশাপাশি জমি খাস করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন বলে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগও জমা পড়ে।

সরকারি কর্মকর্তাদের এমন আচরণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রশাসনবিষয়ক কলামিস্ট ও সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান গতকাল রবিবার রাতে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের অন্যায়ের প্রশ্রয় দেওয়া হয়, শাস্তি না দিয়ে প্রশ্রয় দিলে তো তাদের এমন আচরণ চলতেই থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জানি একজন সরকারি কর্মচারী কখনো সরকারি রাজনৈতিক মিছিলে, সভায় যোগদান করতে পারবে না। কিন্তু আমরা কী দেখলাম, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মমিনুর রহমান প্রকাশে রাজনীতিক বক্তব্য দিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে আবারও ক্ষমতায় আসেন সে জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন- এখানে তিনি সরকারি চাকরি আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। এজন্য তাকে তাৎক্ষণিক সান্সপেন্ড করে, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হওয়ার কথা। কিন্তু সেটি হয়েছে কি? আমরা যা দেখি বিএনপির সময় বিএনপির লোক, বর্তমানে আওয়ামী লীগের লোক- এসব বলে পার করে দেওয়া হয়। তাহলে প্রশাসনে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসার আলমারিতে থাকা ৩৫ লাখ টাকা, পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার, স্বর্ণালঙ্কার, ব্যাংকের চেক, জমির রসিদ ও দলিলপত্র পাওয়া গেছে। তখন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই ইউএনও বাসা থেকে এগুলো উদ্ধার করেছেন। কিন্তু এসব অর্থ-সম্পদ কোথা থেকে তার বাসায় গেল? এর উৎস কী? কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। জনগণ জানতে পারেনি ওই ইউএনওর বাসায় নগদ টাকার তথ্য। এ ঘটনাগুলো তদন্ত করে প্রকাশ করা উচিত। এগুলো সুশাসনের জন্য করা দরকার।

জানা গেছে, সরকারি আচরণ বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা রয়েছে। দেশে বা বিদেশে কারও কাছ থেকে উপহার বা পুরস্কার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত ব্যবসা, রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী সহকর্মীর সঙ্গে আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে তার নির্দেশনা আছে। তবে শুধু নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই। অবশ্য নাগরিকদের সঙ্গে যে কোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে এমন একটি বিধি আছে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালায়। যেখানে অসদাচরণ বলতে অসঙ্গত আচরণ, চাকরি শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে বোঝানো হয়েছে। এ আচরণবিধি এবং চাকরিবিধি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নিয়েই কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়ে থাকেন।

সাম্প্রতিক সময়ে ইউএনওসহ প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার অকর্মকর্তাসুলভ আচরণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত সচিব মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীরকে এসব ঘটনা প্রশাসনকে বিব্রত করে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে কোনো খারাপ কিছুর জন্য সমাজ যেমন বিব্রত হয়, আমরাও বিব্রত হই। প্রত্যেক ঘটনার প্রেক্ষিতে সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

উল্লেখ্য, গত ১০ বছরে প্রশাসনের প্রায় তিন হাজার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নারীঘটিত সমস্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ জমা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত পাঁচশর মতো বিভাগীয় মামলা দায়ের হলেও এগুলোতে একশর মতো কর্মকর্তাকে গুরুদ- ও লঘুদ- দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতির নজির একেবারেই কম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *