হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ কাটা কিংবা চুরির অভিযোগ নিত্যদিনের। এসব অভিযোগ মূলত এয়ারলাইন্সগুলোর বিরুদ্ধে। লাগেজ না পেয়ে প্রবাসীসহ ভুক্তভোগীরা মাঝেমধ্যে বিমানবন্দরেই প্রতিবাদ করেন। দিনের পর দিন এসব ঘটতে থাকলেও কোনো গুরুত্ব দেয় না। ফলে অভিযোগের সুরাহাও হয় না; ধরা পড়ে না জড়িতরা। প্রভাবশালী কারও লাগেজ চুরি কিংবা কাটা পড়লেই কেবল কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, কয়েকটি এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে লাগেজ কাটা, চুরি ও ফেলে রেখে আসার অভিযোগ প্রতিনিয়তই পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা যাত্রীরা। বেশি অভিযোগ আসে ‘সালাম এয়ার’ ও ‘ইত্তিহাদ এয়ারওয়েজ’-এর বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে ‘জাজিরা এয়ারওয়েজ’, ‘এয়ার অ্যারাবিয়া’, ‘ফ্লাই দুবাই’, ‘মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স’, ‘ওমান এয়ার’, ‘গালফ এয়ার’ ও ‘কুয়েত এয়ারওয়েজ’-এর বিরুদ্ধেও।
বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, লাগেজ চুরি প্রতিরোধে কমিটি গঠন করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে হটলাইন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
লাগেজ হারিয়ে গত ১৬ জুলাই বিমানবন্দরে অভিযোগ জানান মির্জা সেলিম নামে এক দুবাই প্রবাসী। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, গত ৮ জুলাই সকালে তিনি এয়ার অ্যারাবিয়ার ফ্লাইটে ঢাকা আসেন। লাগেজ বেল্টে গিয়ে দেখেন তার একটি লাগেজ আসেনি। বিমানবন্দরে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন তিনি। এরপর এয়ার অ্যারাবিয়ার কর্মকর্তারা আশ্বাস দেন, পরের দিন বাড়িতে লাগেজ পৌঁছে দেওয়া হবে। এরপর ১২ জুলাই এসএ পরিবহন থেকে ফোন করে তাদের যাত্রাবাড়ীর অফিসে যেতে বলা হয়। বাড়িতে লাগেজ নিয়ে এসে দেখেন ভেতরের মালামাল চুরি হয়ে গেছে।
তৌহিদ হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী আমাদের সময়কে বলেন, গত ২৩ মে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে তিনি নেপাল থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। বাড়িতে গিয়ে দেখেন, তার লাগেজ থেকে লাখ টাকা গায়েব। এরপর তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বিমানবন্দর আর্মড পুলিশে অভিযোগ জানান। তিনি বলেন, নেপাল যাওয়ার পর আমার কাপড়ের লাগেজে টাকা ছিল। বাংলাদেশে ফেরার সময় লাগেজ থেকে টাকাগুলো হ্যান্ডব্যাগে নিতে ভুলে গিয়েছিলেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. কামরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, লাগেজ কাটা, লাগেজ চুরি ও লাগেজ ফেলে আসার বিষয়গুলো তদন্ত ও সমাধানের জন্য একটি কমিটি আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এয়ারলাইন্সকে সতর্ক করা হয়েছে। বুকিং হওয়া লাগেজ যাতে ফেলে না আসে। লাগেজ না পেলে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের হটলাইনে অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমান পরিচালিত হারানো ও প্রাপ্তি শাখা রয়েছে। লাগেজ চুরি ও হারানো গেলে যাত্রীকে সেখানে লিখিত অভিযোগ দিতে হবে। তার দাবি, বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করা হয়। এখন লাগেজ চুরি হয় না বললেই চলে।
ভুক্তভোগীরা বলেন, লাগেজ চুরির পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি এয়ারলাইন্স প্রবাসী বাংলাদেশিদের লাগেজ বুকিং নিলেও তা ফেলে আসে। লাগেজের জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে থাকেন ভুক্তভোগীরা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে ২ হাজার ৯৪টি ফ্লাইট অবতরণ করে। এসব ফ্লাইটে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৭৪৮ যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার যাত্রীর লাগেজ দেশে আনেনি এয়ারলাইন্সগুলো। দেশে না আনার তেমন কোনো কারণও জানাতে পারেনি তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহজালাল বিমানবন্দর দেশি-বিদেশি ৩১টি এয়ারলাইন্সের সঙ্গে কাজ করছে। বিষয়টি সুরাহা করতে প্রতিটি এয়ারলাইন্সের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। তাদের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও হটলাইন নম্বর সংগ্রহ করে বিমানবন্দরে টাঙানো হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা হটলাইন খোলা থাকে। লাগেজ না এলে তারা এসব নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে লাগেজ রেখে আসা এয়ারলাইন্সগুলোকে শাস্তির আওতায় আনছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। লাগেজ নিয়ে প্রবাসীদের হয়রানি করা হলে বিমানবন্দরে নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানানো যায়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানা করেন ম্যাজিস্ট্রেট। তবে অভিযোগের সংখ্যা বেশি হলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে বেবিচকের কাছে অভিযোগ দিতে পারে। বেবিচক তাদের শাস্তির আওতায় আনে।
বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, সৌদি থেকে আসা লাগেজে যাত্রীরা জমজমের পানি আনেন, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। স্ক্যানিংয়ের পর লাগেজ খুলে পানি ফেলে দেয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। যারা কাপড়ের ব্যাগ বা কার্টনে পানি আনেন, সেগুলো কেটে পানি রেখে দেওয়া হয়। সেই কাটা ব্যাগ দেশে পাঠালে প্রায়ই চুরির অভিযোগ ওঠে। উড়োজাহাজ থেকে লাগেজ নামানোর পর তা বেল্টে দেওয়া এবং যাত্রীর হাতে আসার আগ পর্যন্ত গোটা এলাকাই সিসি ক্যামেরার আওতায়। লাগেজ কাটার অভিযোগ থাকলে খুব সহজেই তার প্রমাণ মিলবে। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বিমানবন্দর যদি যৌক্তিক কারণে যাত্রীর লাগেজ কাটে, তাহলে সেটা যাত্রীকে জানাতে হবে এবং একটা স্লিপ দিতে হবে। তবে সৌদি আরবের জমজমের পানি বের করার বিষয়ে কাউকে অবহিত করা লাগে না।
বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, লাগেজ নিয়ে কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছি। এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি কাস্টমস ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলার, মূলত যারা লাগেজ হ্যান্ডেল করেন, তাদের সতর্কতার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছি। এ বিষয়ে কাজ করতে একটি কমিটিও করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ খুঁজে পেতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তা নিতে হবে। পিআইআর করার ২১ দিনের মধ্যে লাগেজ বুঝিয়ে দিতে না পারলে এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীকে ক্ষতিপূরণ দেবে। এ ছাড়া ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’-এ যাওয়ার আগে তারা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের ফোকাল পয়েন্ট, হটলাইন নম্বর ও কান্ট্রি ডিরেক্টরকে ফোন দিতে পারেন।