সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতের ব্যয় সাশ্রয়ের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা চলছে বেশি। আর এ আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং। অনেকেই বলছেন, এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ে বৈষম্য করা হচ্ছে। সব এলাকায় সমান লোডশেডিং হচ্ছে না; গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এলাকায় লোডশেডিং নেই। যত লোডশেডিং ‘আমজনতার’ এলাকায়। একাধিক এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ে যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা সবাই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে যখনই নিয়মের বাইরে লোডশেডিং হচ্ছে, তখনই মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
সময়সূচির বাইরে কেন লোডশেডিং দিতে হচ্ছে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিতরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক শীর্ষ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা আসলে অসহায়, আমাদের কিছু করার নাই।’ আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে যখন ফারাক বেশি হয়, তখন আর কিছু করার থাকে না। তখন লোডশেডিং শিডিউল ভেঙে দিতে হয়।’
উদাহারণ হিসেবে কর্মকর্তারা জানান, ধরুন কোনো বিতরণ কোম্পানিকে বলা হলো প্রতিদিন ১০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে। ওই বিতরণ কোম্পানি ১০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হবে বিবেচনায় শিডিউল করল। কিন্ত যখন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) থেকে ১০০ মেগাওয়াটের চেয়েও কম বিদ্যুৎ দেওয়া হয়, তখন আর লোডশেডিং শিডিউল অনুযায়ী করা যায় না।
গুরুত্ব বিবেচনায় লোডশেডিং
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) আওতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মন্ত্রীপাড়া, সচিবালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার, বিচারপতিদের বাসভবনসহ আরও অনেক সরকারি অফিস। ডিপিডিসির লোডশেডিং সিডিউলে এসব এলাকায় এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার কথা। কিন্তু বাস্তবে এসব এলাকায় কোনো লোডশেডিং করছে না ডিপিডিসি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘সব এলাকায় লোডশেডিং করার সুযোগ নাই। শিডিউল হয়তো করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এসব এলাকায় লোডশেডিং করা যায় না।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) দিনের বেলা ডিপিডিসি এলাকায় প্রায় ১৩৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। এখন ডিপিডিসির বিতরণ এলাকায় কোনো কোনো ফিডারে যখন নিরবচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়, তখন ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও অন্য এলাকায় শিডিউলের চেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়ে যায়। ওই কর্মকর্তা বলেন, আসলে পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ কম সরবরাহ পেলে তখন যত কথাই বলি, লোডশেডিং শিডিউল ঠিক রাখা কঠিন।
ডিপিডিসির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, মন্ত্রীপাড়ায় লোডশেডিং দিচ্ছেন কিনা? তিনি বলেন, ‘ওই এলাকায় এমনিতেই বিদ্যুতের চাহিদা এক থেকে দেড় মেগাওয়াট। চাহিদা কম; ফলে ওই এলাকায় লোডশেডিং করা হয় না।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, শুধু মন্ত্রীপাড়া নয়, সচিবালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার, মতিঝিল ব্যাংকপাড়ায় লোডশেডিং দেওয়া কঠিন। কারণ এসব গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত।
শুধু ডিপিপিসি নয়, অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেও একই চিত্র দেখা যায়। ঢাকার খুব গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি ( ডেসকো)। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল দিনের বেলা ডেসকো এলাকায় ১৮২ মেগাওয়াট লোডেশিডিং ছিল। তবে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় লোডশেডিং ছিল বেশি।
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমীর আলী আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে। শিডিউল ঠিক করে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং দিতে। কিন্তু যখন চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বেশি ফারাক হয়ে যায়, তখন লোডশেডিং হিসাবের চেয়ে হেরফের হয়ে যায়।’
বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল রাজশাহী-রংপুর এলাকায় সকালের দিকে লোডশেডিং ছিল ১৪৭ মেগাওয়াট। বিকালের দিকে ১৭৯ মেগাওয়াটে দাঁড়ায়। ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)। নেসকোর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমদের সময়কে বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। রাজশাহী এলাকার লোকজন বিদ্যুৎ কম থাকলে অনেক বেশি ডিস্ট্রার্ব করে। ফলে রাজশাহী বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে অন্য এলাকায় বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
নেসকো সূত্রে জানা যায়, গতকাল রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৪২৬ মেগাওয়াট। বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ৩৪৪ মেগাওয়াট। ৮২ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। রংপুর অঞ্চলে সকালে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ২৮৫ মেগাওয়াট। সরবরাহ হয়েছে ২২০ মেগাওয়াট। রাজশাহীতে বিকালে চাহিদা ছিল ৪৩৫ মেগাওয়াট, সরবরাহ হয়েছে ৩৪৬ মেগাওয়াট। রংপুরে বিকালে চাহিদা ছিল ৩০০ মেগাওয়াট, সরবরাহ হয়েছে ২১০ মেগাওয়াট।
বরিশাল-খুলনা এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই এলাকায় বিদ্যুতের স্বাভাবিক চাহিদা প্রায় ৭৮৬ মেগাওয়াট। কিন্তু এখন ঘাটতি থাকে ১৮০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াটের মতো। ফলে বিশাল ঘাটতি মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিতরণ কোম্পানি।
ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আজহারুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, শিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং করতে হলে আগের দিন জানতে হবে কোম্পানি মোট কতটুকু বিদ্যুৎ পাবে। কতটুকু কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। তিনি বলেন, আমরা কতটুকু কম পাব, সেটার ওপর নির্ভর করে শিডিউল তৈরি করতে পারি। কিন্তু যখন ধারণার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কম পাই, তখন শিডিউল ঠিক করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন।
এদিকে দেশের সবচেয়ে বেশি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রায় ৮০টি সমিতির মাধ্যমে দেশের ৮০ ভাগ এলাকায় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আরইবির কোনো কোনো এলাকায় দিনে ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকে না।
শিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং করা যাচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, ‘সরকারের মূল ভাবনা হলো দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা। যার মধ্যে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে উৎপাদন কম করে। আরেক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে মানুষের সাশ্রয় থেকে। কিন্তু বিষয়টা নতুন হওয়ায় এখনো মানুষের কাছ থেকে যে এক হাজার মেগাওয়াট সাশ্রয়ের পরিকল্পনা, সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি বা সরবরাহজনিত কারণে কোনো কোনো বিতরণ কোম্পানি শিডিউল অনুযায়ী লোশেডিং করতে পারছে না। আরও কিছুদিন গেলে বিষয়টি একটা শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসবে।’
এদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হলো বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লা সংকটে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দ্রুতই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়লার অভাবে বড়পুকুরিয়ায় ১২৫ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। ১২৫ মেগাওয়াটের আরেকটি ইউনিট দীর্ঘদিন ধরে মেরামত করা হচ্ছে। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কর্তৃপক্ষ বলছে, আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আবার কয়লা তোলা শুরু হবে। তখন হয়তো আবার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিটগুলো চালু করা যাবে।
পিডিবি সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকালে দেশে বিদ্যুতে চাহিদা ছিল প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন হয়েছে পৌনে ১১ হাজার মেগাওয়াট। বিকালে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
চট্টগ্রামেও নিয়ম না মেনে লোডশেডিং
আমাদের সময়ের চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম শহরের অনেক এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ থাকছে না। শহরতলীর দৃশ্য নগরীর বাণিজ্যক এলাকা কিংবা ভিআইপি এলাকার চেয়ে নাজুক বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গতকাল চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল এক হাজার ৩২২ মেগাওয়াট। বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে সরবরাহ মিলেছে এক হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। সেই হিসেবে গতকাল এ অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫৪ মেগাওয়াট।
পিডিবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেছেন, অনেক সময় লাইন সংস্কারের জন্যও বিদ্যুতের সংযোগ সংশ্লিষ্ট এলাকায় সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। গ্রাহকরা এটাও লোডশেডিং ভেবে ভুল করে থাকেন।