আষাঢ় শ্রাবন মানে না তো মন, ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

`

আষাঢ় শ্রাবন মানে না তো মন,
ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে,
তয়ামকে আমার মনে পড়েছে,
তোমাকে আমার মনে পড়েছে।
আষাঢ় শ্রাবন মানে না তো মন।

আষাঢ় শ্রাবন মানে না তো মন,
ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে,
তয়ামকে আমার মনে পড়েছে,
তোমাকে আমার মনে পড়েছে।
আষাঢ় শ্রাবন মানে না তো মন।

আলোর তরীটি বেয়ে দিন চলে যায়,
আধারের মন জ্বলে তারায় তারায়।
আলোর তরীটি বেয়ে দিন চলে যায়,
আধারের মন জ্বলে তারায় তারায়।

আমার এ মন কেন শুধু আকুলায়,
বরষন যেন কোথা হয়েছে।
তোমাকে আমার মনে পড়েছে।
তোমাকে আমার মনে পড়েছে।

আষাঢ় শ্রাবন মানে না তো মন,
ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে,
তয়ামকে আমার মনে পড়েছে,

দিও না কখন ও কিছু দিও না আমায়,
সবকিছু পাওয়া হবে পেলে গো তোমায়।
দিও না কখন ও কিছু দিও না আমায়,
সবকিছু পাওয়া হবে পেলে গো তোমায়।

চোখের জলেতে বেয়ে সুখ এলো তাই,
আজ মন মোহনাতে মিশেছে,
তোমাকে আমার মনে পড়েছে,
তোমাকে আমার মনে পড়েছে।

আষাঢ় শ্রাবন মানে না তো মন,
ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে,
তয়ামকে আমার মনে পড়েছে,
তোমাকে আমার মনে পড়েছে।
আষাঢ় শ্রাবন মানে না তো মন।

ষড়ঋতুর বাংলায় এসেছে আষাঢ়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশও ছেয়ে… আসে বৃষ্টিরও সুবাস ও বাতাসও বেয়ে।’

রূপময় ঋতু বর্ষার প্রথম দিন পয়লা আষাঢ় আজ। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো ঋতু বর্ষার। বর্ষাকাল চলবে শ্রাবণের শেষ দিনটি পর্যন্ত।

কবিগুরু এই বর্ষাকে নিয়েই লিখেছেন- ‘ঐ আসে ঐ ঘন গৌরবে নবযৌবন বরষা, শ্যাম গম্ভীর সরসা…’ কিংবা ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘনঘোর বরষায়…’।

আমাদের জাতীয় কবি নজরুল লিখেছেন- রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে/ কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে/ কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে/ কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে,/ মনের বনের মুকুল খোলে/ নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে.।

এবার বর্ষা আমাদের দ্বারে এসেছে এক অভিশপ্ত করোনাকালে। করোনায় মৃত্যু দেখতে দেখতে চারদিকে শোকাতুর পরিবেশ। শোকে আচ্ছন্ন গোটা দেশ। মধুময় বর্ষার রূপরস উপলব্ধির সময় কোথায়?

এবার বর্ষা এমন সময়ে এলো যখন গরমের দাপট চলছে । বৃষ্টি হচ্ছে ক’দিন ধরেই, কিন্তু গরম কমছে না।আকাশেও মেঘের ঘনঘটা। আছে নিম্নচাপ, অন্যদিকে ঝিরঝির বৃষ্টি। আসলে প্রকৃতি যেন বলেই দিচ্ছে সময়টা এখন বর্ষার ।

এ সময়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস এ রকম- মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয়। রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা ,চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং ময়মনসিংহ বিভাগের কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারী ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। রাজধানী ঢাকায় জ্যৈষ্ঠের শেষদিনে বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ছিল ৯৭ শতাংশ।

ইতিহাস বলে এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। তাই চারপাশের পরিবেশ বদলে যায়।

চিরকালই আষাঢ় সাজে নানা রূপে। বৃষ্টিরধারায় নবতর জীবন আসে পুষ্প-বৃক্ষে, পত্রপল্লবে, নতুন প্রাণের সঞ্চার করে প্রকৃতির অবয়বে। নতুন সুরের বার্তা নিয়ে সবুজের সমারোহে আগমন বর্ষার। বর্ষা বাঙালী জীবনে চিরকালই কামনার। আজও ফুরায়নি সে আবেদন। কারণ, বর্ষা মানেই সতেজ বাতাসে জুঁই, কামিনি, বেলি, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা আরো কত ফুলের সুবাস। উপচেপড়া পুকুরে রঙিন হয়ে ফোঁটে পদ্ম, সে কেবলই বর্ষাকে পাওয়ার জন্য। কেয়ার বনেও কেতকীর মাতামাতি। আহা কত না মধুর এই বরষা। যদিও সে বর্ষা এখন কল্পনাতেই বেশি খুঁজে নিতে হয়।

কবিগুরুর একটি গানের প্রথম লাইন- ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান’। সম্ভবত এজন্যই কী গ্রাম, কী নগর সর্বত্রই বর্ষার আগমনী বার্তা দেয় ‘কদম ফুল’। যেন একই কথার জানান দিতে পেখম মেলে ময়ূর। বৃষ্টির জল গায়ে নিয়ে নৃত্য করে। তুলে ধরে বর্ষায় প্রকৃতির এমন পরিবর্তনের কথা।

সুখ স্মৃতিগুলো মনে রেখেই প্রতিবছর বর্ষাকে বরণ করে নেয় বাঙালী। বিশেষ করে শহরে নগরে হরেক আয়োজনে চলে বর্ষা বন্দনা। প্রতিবারের মতো এবার করোনা পরিস্থিতির জন্য রাজধানীতে এবার বর্ষাবরণের নানা আয়োজন হয়তো থাকবেনা। তাই বলে প্রতিটি মনেই বেজে ওঠা বর্ষার রাগিনীকে দমিয়ে রাখা যাবেনা।

বর্ষা যেমন আনন্দের, তেমনি বিষাদে ভরিয়ে তোলারও। তবুও বর্ষা বাঙালী জীবনে নতুনের আবাহন।

মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশ অনেকদিন আগে। কিন্তু এবার ঘটা করে বর্ষারানি হাজির হলো। আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ। গত বছরের করোনার আষাঢ় আবার তার নূপুরের শব্দ শোনাল। হয়তো এই দুঃসময়ে কদম, কেতকী ধোয়া বৃষ্টি বাঙালির হৃদয়ে সাহস জোগাবে আরও একবার। বর্ষা মানেই আবেগ, অনুভূতির জোয়ার। এ জোয়ারে ভাসেননি এমন কবি, সাহিত্যিক পাওয়া যায় না। শুধু যে কবি-সাহিত্যিক, তা নয়-সাধারণ মানুষও। কালীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বা নির্মলেন্দু গুণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হুমায়ূন আহমেদ-কেউ বর্ষাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিনে বর্ষা এক বিপুল বিস্ময় নিয়ে আবির্ভূত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বর্ষা-মঙ্গল’ কাব্যে লাবণ্যস্নিগ্ধ রূপবতী বর্ষাকালকে নিয়ে লিখেছেন, ‘ওগো সন্ন্যাসী, কী গান ঘনাল মনে।/গুরু গুরু গুরু নাচের ডমরু/বাজিল ক্ষণে ক্ষণে।/তোমার ললাটে জটিল জটার ভার/নেমে নেমে আজি পড়িছে বারম্বার/বাদল আঁধার মাতাল তোমার হিয়া,/বাঁকা বিদ্যুৎ চোখে উঠে চমকিয়া।’ বর্ষার বন্দনায় কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘গ্রীষ্ম চলিল, বর্ষা আসিল, আষাঢ়ে নামিল ঢল;/বুনো পাখি সব ডাকে অবিরল : ‘বাওয়া ক্ষেত কর তল।’/এই তো কখন নেমেছে বৃষ্টি, অবিরাম তবু ঝরছে;/না পেয়ে উপায় রাখালের দল ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছে।’

আষাঢ় ও শ্রাবণ-দুই মাস বর্ষাকাল। আর বর্ষাকাল মানেই মেঘ, বৃষ্টি, প্রেম, নতুন প্রাণ, জেগে ওঠার গান। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাই তো বলেছেন, ‘এই জল ভালো লাগে;- বৃষ্টির রুপালি জল কত দিন এসে/ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে/তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে,- আবেগের ভরে।’ বর্ষা আমাদের মনকে স্নিগ্ধ করে তোলে। পুরোনো জঞ্জাল ধুয়েমুছে আমরাও জেগে উঠি প্রাণচাঞ্চল্যে। বর্ষা আমাদের জন্য অপরিহার্য এক ঋতু। বৃষ্টি না হলে শস্যাদি জন্মাবে না, বেড়ে উঠবে না প্রাণ। বৃষ্টির অভাবে মাটি যখন অনুর্বর হয়ে যায়, তখন বর্ষা এসে তা উর্বর করে। আমাদের নদী, মাঠ, ঘাটের দেশ বর্ষায় ভরে ওঠে সবুজে শ্যামলে।
বর্ষার পানিতে নদীনালা, খালবিল ভরে ওঠে। সেখানে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। তাই বর্ষা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। এক পশলা বৃষ্টি যে নতুন মাত্রা নিয়ে আসে জীবনে, তা অন্যকিছুতেই পাওয়া যায় না।

বর্ষায় বাংলার নদনদী পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। নদীর ফেঁপে ওঠা জোয়ারের পানি প্রচুর পলি জমায় মাটিতে, যা নিয়ে আসে শস্যের প্রাচুর্যের খবর। এ সময় বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা-শালুক। হিজল আর কেয়াফুলের অরূপ দৃশ্য মোহিত করে মনকে। বর্ষাকাল গ্রামের মানুষকে অনেক বেশি ঘরমুখো করে তোলে। রমণীরা ঘরে বসে নকশিকাঁথায় ফুল তোলে। অনেকটা আলস্যে কেটে যায় দিন। বৃষ্টি বেশি হলে গরিব মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকে না। বর্ষায় ফোটে কদম ফুল, যা বর্ষার রূপকে বাড়িয়ে দেয়। আরও ফোটে কেতকী। শহরের একঘেয়ে যান্ত্রিক জীবনে বর্ষা কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে। বৃষ্টি শহরের ধুলোবালিকে বশ করে। তবে বর্ষায় শহরের রাস্তাঘাট অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়, যা মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়। অতি বর্ষণে দেখা দেয় নদীভাঙন ও বন্যা। বাংলার কৃষি ও অর্থনীতি বৃষ্টিনির্ভর। যথাযথ বৃষ্টিপাত ফসল ফলাতে সহায়তা করে। অন্যদিকে অনাবৃষ্টি ও খরায় কৃষি ভেঙে পড়ে। তাই বর্ষাকাল আমাদের জীবনে সামগ্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *