মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আরও ১৪৩ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেট আকারে প্রকাশ

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় অনুগামীদের হাতে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ধাপে ধাপে প্রকাশ করছে সরকার। ইতোমধ্যে দুই পর্বে ৩৩৪ জনের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও দেশের এই সূর্যসন্তানদের তালিকা পেতে জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছর।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয় ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর। মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব তপন কান্তি ঘোষকে সভাপতি এবং উপসচিব রথীন্দ্রনাথ দত্তকে সদস্য সচিব করে গঠিত ওই কমিটির সদস্য ছিলেন অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুল হক ভুঁঞা। গবেষক সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. হাজী সালেহ উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল, অধ্যাপক ডা. বায়েজদ খুরশীদ রিয়াজ, গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি ড. চৌধুরী শহীদ কাদের। এ ছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্য ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ জহির (বীরপ্রতীক)।

মুক্তিযুদ্ধকালীন শহীদদের মধ্যে কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন, তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করাই ছিল এই কমিটির মূল দায়িত্ব। সেই সঙ্গে তারা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করে তাদের নাম, বাবার নাম, ঠিকানাসহ মতামত দেন। তার জন্য বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ, পত্রিকা কাটিং, টিভি রিপোর্ট, অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্যের সহযোগিতা নেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে সারাদেশের জন্য সময়কাল ধরা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে ঢাকা জেলার ক্ষেত্রে এ সময়কাল কিছুটা বাড়িয়ে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত করা হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা: কাজ করতে গিয়ে কমিটি প্রথমেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। আর সেই সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- যেসব সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক-সংগীত ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি; যারা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী, কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন- তারাই শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য হবেন। আর সেই অনুসারে এবং রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬-এর সিডিউল-১ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল প্রথম পর্বে ১৯১ জনের নাম প্রকাশ হয়। দ্বিতীয় পর্বে ১৪৩ জনের তালিকার গেজেট প্রকাশ হয়েছে গতকাল রবিবার। এখন পর্যন্ত দুই পর্বে মোট ৩৩৪ জনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশের সূর্যসন্তানদের তালিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ৫০ বছর। তবে দীর্ঘসময় পর হলেও যে এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটিই বড় বিষয়।’ তালিকায় আরও নাম যুক্ত হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আরও অনেক নাম যুক্ত হবে। সময় নির্ধারণ না করে এই প্রক্রিয়া চলমান রাখা উচিত। কারণ অনেকেরই পরিবার হয়তো দেশের বাইরে থাকেন। তারা যদি পরে দেশে এসে নাম অন্তর্ভুক্তি করতে চান, সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। তা ছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি করে এ ধরনের তালিকা সঠিকভাবে প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় কমিশন করতে হবে, যা ডিসি বা ইউএনওদের দিয়ে সম্ভব নয়।’

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত কমিটির ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, বিভিন্ন সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি অথবা কোনো মহল থেকে বিতর্কিত হওয়ার সুযোগ থাকে এমন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করা যাবে না। সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়- ডাক ও টেলি যোগাযোগ বিভাগ থেকে ১৫২ জনের তালিকা পাওয়া গেছে, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে ২০৭ জনের তালিকা পাওয়া গেছে, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের করা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ১ হাজার ৭০ জনের একটি তালিকা রয়েছে। এর বাইরেও কোনো তথ্য পাওয়া গেলে তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সাত সদস্যের উপকমিটি গঠন করা হয়। লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরকে (বীরপ্রতীক) আহ্বায়ক করে এবং রথীন্দ্রনাথ দত্তকে সদস্য সচিব করে গঠিত ওই কমিটির সদস্য ছিলেন সংসদ সদস্য আরমা দত্ত, অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিন, অধ্যাপক বায়েজীদ খুরশীদ রিয়াজ, ডা. নুজহাত চৌধুরী, ড. চৌধুরী শহীদ কাদের।

যাচাই-বাছাই প্রসঙ্গে উপকমিটির আহ্বায়ক লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক) বলেন, ‘সরকারি একটি নীতিমালা রয়েছে। সেটি অনুসরণ করেই যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’ বিতর্ক রয়েছে এমন কারও নাম অন্তর্ভুক্তির সুয়োগ রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় যারা গেজেটভুক্ত হয়েছেন বা রেকর্ডে স্থান পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কিছু করার নেই। তা ছাড়া আরও অনেক বিতর্ক রয়েছে। সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রণয়নের চেষ্টা করছি।’

এ বিষয়ে কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. বায়েজীদ খুরশীদ রিয়াজ বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে কমিটি কাজ করছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। তালিকাটি আরও দীর্ঘ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই কার্যক্রমের ফলে আমাদের সূর্যসন্তানদের নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *