জলবায়ু পরিবর্তনে অসময়ে ভারী বর্ষণ ভেসে যাচ্ছে ফসল

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

দেশে বৃষ্টির ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এ সময়ে যেমন বৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি ভরা বর্ষায় কমে গেছে বৃষ্টির পরিমাণ। সাধারণত মৌসুমি বায়ুর শুরু জুন থেকে এবং শেষ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা কিন্তু বর্তমানে ফেব্রুয়ারি থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হচ্ছে। আবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি এক কিলোমিটারের মধ্যে বৃষ্টিপাতের ধরনেও নানা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ঢাকায় রামপুরায় বৃষ্টি হলে মতিঝিলের রাস্তা খটখটে শুকনো দেখা যায়। ফলে আবহাওয়া অফিস আগারগাঁওয়ে বৃষ্টি না হলে যখন বলে ঢাকা কোনো বৃষ্টি হয়নি, তখন পল্টন এলাকার মানুষ তা বিশ্বাস করে না। দেখা যায় পল্টনে মুহূর্তেই রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসবই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি।

পৃথিবীর জলবায়ু পদ্ধতির পরিবর্তনে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর প্রভাব রয়েছে। এর মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী নগরায়নের হার, কলকারখানার পরিমাণ, বনভূমির উজাড় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হারও বাড়ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের একটি যদিও বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউজ গ্যাসের মাত্র ০.৪০ শতাংশ নিঃসরিত হয় বাংলাদেশে অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভূমিকা নেই বললেই চলে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর উন্নত জীবনযাপনের বলি হচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউজ গ্যাসের মাত্র ০.৪০ শতাংশ নিঃসরণ করে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশই এখন জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ দেশগুলোর একটি।

গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬৮-২০১৮ সালের মধ্যে এই ৫০ বছরে দেশে দিন ও রাত অধিকতর উষ্ণ হয়েছে। অন্য দিকে দিন ও রাতের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। গত পাঁচ দশকে উষ্ণ দিনের সংখ্যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় প্রতি বছরে গড়ে ০.৩৯৪ দিন এবং দেশের অভ্যন্তরভাগে ০.১৫ দিন করে বেড়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে উষ্ণ দিনের সংখ্যা ০.৫০৭ দিন করে প্রতি বছর বাড়ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রার চেয়ে বৃষ্টিপাতের সূচকগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপেক্ষাকৃতভাবে কম পরিবর্তিত হয়েছে। বরিশাল, দিনাজপুর, ফরিদপুর ও রাজশাহীতে বার্ষিক ভারী বর্ষণের দিন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ফলে উত্তরবঙ্গে খরা বাড়তে পারে। উত্তরবঙ্গের দিকে বৃষ্টিপাত কমলেও নগর এলাকাগুলোতে ভারী ও চরম বৃষ্টিপাতের দিনের সংখ্যা বাড়ছে। গত পাঁচ দশকে দেশের অভ্যন্তরে টানা শুষ্ক দিনের সংখ্যাও কমেছে। অন্য দিকে উপকূলীয় নিম্নভূমির দিকে বৃষ্টিপাতের হার দিন দিন বাড়ছে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত আচরণের কারণে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর উদাহরণ হচ্ছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার হাওরে আগাম বন্যার কারণে বোরো ধান ঘরে তুলতে পারেননি কৃষকরা। কারণ এ বছর আগাম ভারী বর্ষণ হয়েছে, ভারতের মেঘালয় থেকে উজানের পানির তোড়ে ভেসে গেছে উল্লিখিত এলাকার ধান ক্ষেত।

জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধির কারণে হিমালয় আগের চেয়ে দ্রুততার সাথে গলছে। হিমবাহ গলনে চলতি বছর বাংলাদেশে বন্যার পরিধি বাড়বে। একই কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে দীর্ঘমেয়াদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি ও দাবদাহ বাড়বে। অন্য দিকে সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়া, কলেরা ও অন্যান্য রোগের প্রকোপ তীব্রতর হবে। ফলে বাড়বে স্বাস্থ্যঝুঁকি।’

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ভারত মহাসাগরের উপরিতলের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। ফলে অতিরিক্ত উষ্ণতা দৈনন্দিন জীবনকে দুঃসহ করে তুলছে। দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন রোগব্যাধি। ২০০০ সালের আগে বাংলাদেশের মানুষ ডেঙ্গুজ্বর কী তা জানত না, এমনকি চিকিৎসক-গবেষকরা ছাড়া সাধারণ মানুষ চিকুনগুনিয়ার নামও শোনেনি। এখন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এটি জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ঘটেছে বলে বলছেন জলবায়ু গবেষকরা।

২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এই শতাব্দীর শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার ব্যাপারে চুক্তি। কিন্তু সে চুক্তিও ধনী দেশগুলো অনীহায় বাস্তবায়ন হয়নি। আগামী ২০৩৮ সালের মধ্যেই পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্পযুগের পর থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাপমাত্রা আরো নিচে রাখতে না পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান হার আরো বেড়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *