দেশের ৪১ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে পারছেন না। রাজধানীর বাজারগুলোতে গোশতের বিক্রি কমেছে; পাংগাস-তেলাপিয়া মাছের চাহিদা বেশি। কেউ প্রয়োজনের অর্ধেক সবজি, কেউ কমদামে ফুটপাত থেকে আধাপচা সবজির ভাগা কেনেন। ছেলেমেয়েদের কোচিং কমিয়ে দিয়ে মধ্যবিত্তের অনেকেই সংসারে খাবারের যোগান দিচ্ছেন। ডাল-আলু-ভর্তা হাজারো পরিবারের এখন নিত্য খাবার মেন্যু। এক গবেষণায় বলা হয়েছে দেশের ৪১ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ নেই। ৪০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে এবং অণুপুষ্টিকণার ঘাটতির শিকার। ৫৪ শতাংশের বেশি প্রাক-স্কুলগামী শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ওজন কম ৫৬ শতাংশ শিশুর। পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে ৪৩ শতাংশ মানুষ পুষ্টিকর খাবারের খরচ কমিয়েছেন।
যাত্রাবাড়ির মাছ-সবজি-ফলমূলের আড়তের পাশে কুতুবখালির রাস্তার ওপর সারি সারি ফলমুল-তরিতরকারির খুচরা দোকান। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে ও ঢাকা চিটাগাং রোডের ফুটপাতের এই দোকানে সব ধরনের নিম্নমানের আধাপচা সবজি, মাছ, ফলমুলের ‘ভাগা’ দিয়ে বিক্রি করা হয়। নিম্নআয়ের মানুষ খুবই কম দামে আধাপচা এসব পণ্য ক্রয় করে থাকেন। গত এক সাপ্তাহ এই দোকানগুলোতে দেখা যাচ্ছে ভালো কাপড়-চোপড় পরিহিত মানুষ সবজি কিনছেন। মাহিলাদের অনেকেই বোরকা পরে এসে ভাগা দেয়া পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ভালো পোশাক পরিহিত কারা কিনছেন রাস্তার পাশে ফেলে দেয়া আধাপচা সবজি, তরকারি! প্রথম দিন কৌতুহলবশত এবং দ্বিতীয় দিন পেশাগত কারণেই বাস থেকে নেমে পরিচিত এক মুখ পাওয়া গেল। তিনি পচা বেগুন আর ঢেরস কিনছেন। প্রতিবেদককে দেখে সাপ দেখার মতো চমকে উঠলেন। ভনিতা না করেই বললেন, এখানে কম দামে সবজি পাওয়া যায়। তাই প্রতিদিন সকালে এখান থেকে সবজি কিনে বাসায় দিয়ে অফিসে যাই। পরিচিত মুখ পুরনো বন্ধু বললেন, মানুষের দুর্গতি দেখতে আসছেন? চলেন ফুটপাতের চায়ের দোকানে। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝতে পারবেন কারা বাধ্য হয়ে এসব দোকানো আধাপচা পণ্য ক্রয় করছেন। মোছা. ছাবিহা নামের এক দোকানি বললেন, আগে এখানকার ক্রেতা ছিলেন নিম্নআয়ের মুটেকুলি, রিকশার গ্যারেজ, ভিক্ষুক ও বস্তির মানুষ। এখন মধ্য-মানের চাকরিজীবীরাও এখান থেকে কম দামে সবজি কিনছেন। মানুষের আয় রোজগার বাড়েনি; অথচ প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সীমিত আয়ের মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে এখানে কম দামে নিম্নমানের পণ্য ক্রয় করে থাকেন। ফুটপাতের দোকানি সাবিহা পরামর্শ দিলেন পাশের কাজলা, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ি কাঁচা বাজারে গিয়ে দোকানিদের কাছ থেকে পরিস্থিতি বুঝা যাবে।
ওই দোকানির পরামর্শে যাত্রাবাড়ির ফারুক রোড, কাজলা ও শনির আখড়া বাজারে যেতে হলো। মুদি দোকানিরা জানান, পণ্য প্রচুর থাকলেও কেনাবেচা আগের চেয়ে কম। প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এক কসাই জানালেন, আগে শুক্রবার দু’তিনটি গরু জবাই দেয়া হতো। এখন একটি গরু জবাই করলে রাত অব্দি থাকতে হয় গোশত বিক্রির জন্য। শনির আখড়া বাজারে আগে চারটি খাসির গোশত বিক্রির দোকান ছিল। এখন একটি দোকানে খাসির গোশত বিক্রি হয়। মানুষ গোশত কেনা কমিয়ে দিয়েছে। মাছের বাজারেও একই চিত্র। মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন পাংগাস, তেলাপিয়া, চাষের কই মাছের বিক্রি বেশি। শোল, মাগুর, শিং, রুই, কাতলের চাহিদা আগের চেয়ে কম। কাজলা বাজারে দাঁড়িয়ে আনোয়ারুল ইসলাম নামের এক বেসরকারি চাকুরে বললেন, আগে প্রতি শুক্রবার গরুর গোশত কিনতাম। এখন দাম বেড়ে যাওয়ায় মাসে দু’বার গরুর গোশত কিনি। আর উদ্ভট গন্ধের কারণে পাংগাস, তেলাপিয়া মাছ কোনোদিনই বাসায় তুলিনি। এখন বাধ্য হয়েই সেই কম দামের মাছ কিনতে হয়। সংসারে বেশির ভাগ সময় ডিম খাই। অথচ সেই ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। প্রতি পিছ ডিম এখন ১১ টাকা।
পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নাগরিক জীবন বিপণœ করে তুলেছে। পরিবারের খাওয়ার খরচ মেটাতে পারছেন না অনেক পরিবারের কর্তা ব্যক্তিরা। বাধ্য হয়েই মানুষ খবারের মেন্যুতে মাছ-গোশত-ডিম কমিয়ে দিয়েছেন। সংসারে যতটুকু প্রয়োজন তার অর্ধেক কিনে ‘গৃহকত্রীকে চালিয়ে নেয়ার’ অনুরোধ করছেন।
বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রত্যেকেই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আয় বাড়েনি অথচ প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। গত দু’দিনে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ টাকা থেকে ৪ টাকা। আটার দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত। সবজি, চাল, আটা কিনতেই সব টাকা শেষ হয়ে যায়, মাছ-গোশত কিনব কীভাবে?
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খাবারের খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে অধিকাংশ নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। ব্যাংকে চাকরি করেন মোহাম্মদ আফসার হোসেন। বললেন, সবকিছুই দাম বেড়ে যাওয়ায় মেয়ের প্রাইভেট পড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। ছেলেকে ভালো স্কুল থেকে সরিয়ে এনে অন্য স্কুলে ভর্তি করেছি। তারপরও মাসের বেশির ভাগ দিনই আমরা ভাত, ডাল, আলু ভর্তা খাই। মাঝেমধ্যে ডিম খেতাম সে ডিমের দামও বেড়ে গেছে। বেশ কয়েকজন পেশাজীবী জানান, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের সংসার আর চলছে না। তারপরও সংসার চালাচ্ছেন খেয়ে না খেয়ে। সংসারের অন্যান্য খরচ কমিয়ে খাবার চাল-আটা কিনছেন।
জানতে চাইলে প্রফেসর ড. এম আক্তারুজ্জামান বলেন, সঙ্কট মূলত অনেক আগ থেকেই ছিল এবং করোনা এসে সেটাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। এখন আবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সবমিলিয়ে একটা মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে দেশ। এই সঙ্কট আরো দীর্ঘায়িত হলে অবশ্যই দেশের প্রান্তিক মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এখন পর্যন্ত কোনো সার্ভে বা জরিপ না হওয়ায় ঠিক বলা যাচ্ছে না যে কত মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। তবে আনুমানিক দেশের ৩০ শতাংশ মানুষই সুষম খাবারের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন।
এ সঙ্কট মোকাবিলায় তিনি ধনীক শ্রেণির জনগণকে দরিদ্রদের দিকে এগিয়ে আসার আহŸান জানিয়ে বলেন, সরকারিভাবে ন্যায্য মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। টিসিবির পণ্যের পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে যাতে গরিবদের নাগালে খাবার যায়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের সা¤প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আর্থিক সঙ্কট থেকে বাঁচতে ৪৩ শতাংশ মানুষ তাদের খাবারের খরচ কমিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের (ডিজিএইচএস) তথ্যমতে, ৫৪ শতাংশের বেশি প্রাক-স্কুলগামী বয়সের শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, ওজন কম ৫৬ শতাংশ শিশুর। ইউএসএআইডি বলেছে যে বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ গর্ভবতী নারী এবং মা হননি বা স্তন্যদানকারী নন এমন ৪০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। ৫৭ শতাংশ গর্ভবতী/ স্তন্যদানকারী নারীর জিঙ্কের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়াও, ১৫-১৯ বছর বয়সি অবিবাহিতদের মধ্যে ৮ শতাংশের ওজন কম। সব হচ্ছে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে না পারায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক খালেদা ইসলাম বলেন, ডিমের প্রোটিন অনেক উচ্চ মানের। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্যই পুষ্টি নিশ্চিত করতে ডিম খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ডিম সবসময় সুবিধাবঞ্চিতদের নাগালের মধ্যে থাকা উচিত। ডিমের দাম বাড়লে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের পুষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অনারারি অধ্যাপক পুষ্টিবিদ এবং ড. খুরশীদ জাহান বলেন, আগে বলা হতো গরিবের প্রটিন হলো ডাল-ডিম। এখন সেই ডিম-ডালের দামও বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ প্রয়োজনীয় প্রোটিন, নিউট্রিশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দিনে গড়ে ২১০০ কিলো ক্যালোরির প্রয়োজন। একজন মানুষ প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন, নিউট্রিশন না পেলে তার প্রভাব পড়ে তার কাজে। প্রত্যেক মানুষের বয়স, উচ্চতা, ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির ওপর ভিত্তি করে ক্যালোরি, প্রোটিন রিকয়ারমেন্ট আছে। প্রতিদিন প্রয়োজনীয় খাবার না খেলে শিশুদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হবে।
২০২১ সালে করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৪১ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ নেই। দারিদ্র্যসীমার নিচে বা দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে থাকা পরিবারগুলো স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে পারছে না। বিভিন্ন সূচকে শিশুপুষ্টির উন্নতির তথ্য দিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ধান ও মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে। তারপরও দেশের মানুষ তিন মাত্রার অপুষ্টির ঝুঁকিতে আছে। দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সি ২৮ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম ও ৮ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার। ৪০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে অর্থাৎ তারা অণুপুষ্টিকণার ঘাটতির শিকার। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক ১৬ শতাংশ পুরুষ ও ১৮ শতাংশ নারীর ওজন বেশি। ওজন বেশি এমন নারী-পুরুষের মধ্যে স্থ‚লতা বাড়ছে। এসব অপুষ্টির একটি কারণ পুষ্টিজ্ঞানের ঘাটতি।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় আছে ৮ শ্রেণির খাদ্য: শস্য (চাল, গম), ডাল, সবজি (পাতাসহ সবজি ও পাতাবিহীন সবজি), ফল, গোশত-মাছ-ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত, তেল এবং মিষ্টি (গুড়, চিনি, মধু)। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যে ৮ শ্রেণির খাদ্য থাকাই যথেষ্ট নয়, তাতে প্রয়োজনীয় ক্যালরি ও অত্যাবশ্যকীয় অণুপুষ্টিকণাও থাকতে হবে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সেটা পূরণ করা সম্ভব হয় না।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর নাজমা শাহীন বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট ও তার প্রভাব সম্পর্কে করোনার পর বাংলাদেশে কোনো গবেষণা করা হয়নি। সুতরাং নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যের ভিত্তিতে কথা বলা যাচ্ছে না। তবে এটা তো সবাই বুঝতে পারে যে, যখন দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয় তখন মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে হয়। যেমন কেউ তার বাড়ি ভাড়া তো কমাতে পারবে না। তাই তাকে অন্য কিছুতে খরচ কমাতে হবে। আগে যারা মাছ, গোশত, দুধ আর ডিম খেত তাদের এখন শুধু মাছ আর ডিম খেয়েই থাকতে হবে। আবার যারা ডাল ভাত খেয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করত তাদের ক্ষেত্রে অনেককেই ক্ষুধার্ত থাকতে হবে। এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় অনেক মানুষকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগতে হচ্ছে বা হবে। এটাই স্বাভাবিক। এই সঙ্কট যদি খুব বেশি দীর্ঘায়িত হয় তখন দেশে চরম অস্থিরতা তৈরি হবে যা ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।
এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, আমাদেরকে পণ্য আমদানি থেকে বিরত থেকে দেশীয় পণ্য উৎপাদনে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। কারণ আমদানি করতে গেলে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে সে পরিমাণ অর্থ খরচে দেশে আরো বেশি পরিমাণ খাদ্য ও পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব।