পাকিস্তান কি দেউলিয়া হবে?

Slider সারাবিশ্ব


সন্ত্রাসবাদ থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেকারত্ব; দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের নানা সংকটে বিপর্যস্ত পাকিস্তান। সম্প্রতি ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরাতে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবে টালমাটাল হয়ে ওঠে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। অনেক নাটকীয়তা শেষে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শাহবাজ শরিফ। তবে সংকট কাটেনি।

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রাজনৈতিক এ অস্থিরতা আগামী দিনে সহিংসতায় রূপ নিতে পারে, যা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। আর দেশটিকে নিয়ে যাবে দেউলিয়াত্বের দিকে।

পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে ধারাবাহিকভাবে, বাড়ছে খাদ্যমূল্যস্ফীতি। পাকিস্তানি রুপির অবস্থানও ভালো না। ডলারের বিপরীতে চলতি বছর রুপির মান কমেছে ২১ দশমিক ৭২ শতাংশ।

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আর্থিক জরুরি অবস্থা জারির দাবি জানিয়ে আসছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা। করপোরেট সেক্টরের জন্য উপলব্ধ ৮০০ বিলিয়ন রুপি কর ছাড় প্রত্যাহার করার পাশাপাশি জমি ও সম্পত্তির ওপর উচ্চকর আরোপ করার পরামর্শ তাদের।

স্থানীয় অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা ব্যয় হ্রাস, ১৬০০ বা তার বেশি সিসির গাড়ির ওপর বিশেষ জরুরি কর বসানো, ৮০০ বর্গগজ বা তার বেশি আবাসিক সম্পত্তির ওপর বিদ্যুতের শুল্ক দ্বিগুণ করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভাগগুলোর আকার কমানো প্রয়োজন।

ইসলামাবাদভিত্তিক পাকিস্তানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্লেষক ফররুখ সেলিম এশিয়া টাইমসকে বলেন, ডলারের প্রবাহ হ্রাস এবং চীন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মতো বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সমর্থনের অভাবে পাকিস্তানি রুপির ওপর চাপ বাড়ছে।

বিপর্যস্ত অর্থনীতি

ফররুখ সেলিম জানান, পাকিস্তানের বিপর্যস্ত আর্থিক বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। এ ছাড়া স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এসবিপি) কাছে মাত্র ১০ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার অবশিষ্ট রয়েছে। যার মধ্যে চীন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে পাওয়া নগদ ঋণের পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলার।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার আহ্বান জানান অর্থনীতিবিদ ফররুখ।

গত মাসে অনাস্থা প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হবার পর দেশের বিভিন্ন রাজ্যে একের পর এক জনসভা করছেন পিটিআই নেতা ইমরান খান। ব্যাপক জনসমাগম হওয়া এসব সমাবেশে জনসাধারণকে ‘মার্কিন আধিপত্য এবং এর বিরুদ্ধে জেগে উঠতে উদ্বুদ্ধ করছেন’ তিনি। ইমরানের অভিযোগ, ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক উপায়ে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।

২০১৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ইমরান খানের দাবি, ক্ষমতায় থাকাকালে তার সঙ্গে ‘চমৎকার’ সম্পর্ক ছিল দেশটির ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর। কিন্তু বিদেশি ও স্থানীয় ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়ার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সমর্থন পাননি তিনি।

ইমরান বলেন, সামরিক নেতৃত্বকে আমি জানিয়েছিলাম যে বিরোধীদের পরিকল্পনা সফল হলে পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।

রিজার্ভ এবং জ্বালানি ভর্তুকি

চলতি বছরের গত ৬ মে পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকের আমানত বাদ দিয়ে ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল মাত্র ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে সর্বোচ্চ চার সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

দেশের অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা এবং অর্থনীতির খারাপ অবস্থা অনুধাবন করে পরামর্শ দেয়ার জন্য গত ১০ মে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং দলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের লন্ডনে তলব করেন পিএমএল-এন নেতা নওয়াজ শরিফ। এর থেকে স্পষ্ট হয় যে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের বর্তমান সরকার।

গেল মার্চে পাকিস্তানের চলতি হিসাবের ঘাটতি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট ঘাটতি ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্য বলছে, গত বছরের একই সময়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আমদানি বেড়েছে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ২৮ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানির তুলনায় জুলাই-মার্চ মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে মোট ৬২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার।

ক্রমবর্ধমান আমদানি বাণিজ্য ঘাটতি বাড়িয়েছে, ধ্বংস করেছে মুদ্রার বিনিময় হার। কারণ চলতি অর্থবছরে পাকিস্তানে ডলারের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেশি ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশটির মোট বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা নড়বড়ে অর্থনৈতিক অবস্থানেরই ইঙ্গিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল এ ঘাটতির ফলে অর্থপ্রদানের ভারসাম্য সংকটে ডুবে যেতে পারে পাকিস্তান।

পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সহসভাপতি মরিয়ম নওয়াজ সম্প্রতি এক জনসভায় বলেন, নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে থাকা পাকিস্তানের অর্থনীতি ইমরান খান সরকারের অযৌক্তিক অর্থনৈতিক নীতির কারণে এখন ভেন্টিলেটরে স্থানান্তরিত হয়েছে।

সামনে দীর্ঘ পথ

মরিয়ম নওয়াজের মতে, কয়েক মাস নয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের তৈরি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ‘জগাখিচুড়ি’ ঠিক করতে কয়েক বছর লাগবে। মরিয়মের অভিযোগ, ইমরান জাতিকে বিভক্ত করেছেন, অর্থনীতিকে দুর্বল করেছেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কলঙ্কিত করেছেন এবং জনসাধারণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন অতিরিক্ত করের বোঝা।

পাকিস্তানের ব্যাপক খাদ্যমূল্যস্ফীতি (১৭ শতাংশ) দেশটির দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছে। জরুরি চাহিদা মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। সরকার সামনে গিয়ে যখন জ্বালানি ভর্তুকি প্রত্যাহার করবে, তখন মুদ্রাস্ফীতির একটি নতুন তরঙ্গ আঘাত হানবে বলে এরইমধ্যে সতর্ক করেছেন পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদরা।

ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে যান শাহবাজ শরিফ। তার এ সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল আর্থিক সহায়তা পাওয়া। কিন্তু দেশ দুটির কাছ থেকে এ ধরনের কোনো আশ্বাস পাননি শাহবাজ। আবেদন করা সত্ত্বেও সহায়তার জন্য সাড়া দেয়নি চীনও।

পাকিস্তানের সিটি গ্রুপের ইমার্জিং মার্কেট ইনভেস্টমেন্টের সাবেক প্রধান ইউসুফ নাজার একাধিক টুইট বার্তায় বলেছেন যে, সরকার পেট্রোলিয়ামের দাম না বাড়ালে আইএমএফ এবং অন্যান্য বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলো খুব বেশি প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেবে না।

কিন্তু তিনি দাবি করেন, এই পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

ইউসুফ নাজারের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থান স্থিতিশীল করতে এবং রুপিকে শক্তিশালী করতে পাকিস্তানের ১৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আইএমএফের তাৎক্ষণিক সহায়তা (বেল আউট) ছাড়া পাকিস্তানের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।*

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *