দেশীয় শস্য থেকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত সরিষার উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

কৃষক আব্দুল্লাহ হারুন। এ বছর প্রায় পাঁচ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছিলেন। কিন্তু বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি জমে নষ্ট হয়ে যায় ফসল। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগামী বছর তিনি আর সরিষার চাষ করবেন না। তিনি মানবজমিনকে বলেন, সরিষা, ধান, কলা চাষ করছি। এ বছর ৫ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করি। কিন্তু পাঁচ বিঘা জমিই বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে। কথা হয় কৃষক রঙ্গু মিয়ার সঙ্গে। তিনিও বলেন, তারও এবার ৭-৮ বিঘা জমির সরিষা নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক টাকা লস গেছে তার

সেজন্য আগামী বছর ঝুঁকি নিতে চান না। কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, সরিষার ফলন বাড়াতে হলে কৃষি প্রণোদনা আরও বাড়াতে হবে। কৃষকদের উন্নত জাতের ফলন, চাষাবাদের সঠিক সময় সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে দেশীয় শস্য থেকে ১৫-২০% ভোজ্য তেল উৎপাদিত হচ্ছে। এটি ৫০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এজন্য সব সরিষা চাষিকে প্রণোদানা দিতে হবে। কৃষক যাতে ন্যায্য মূল্য পান সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এক সময় প্রায় সব কৃষকই সরিষা চাষ করতেন। কিন্তু এখন অনেক কৃষক লাভবান হতে না পেরে সরিষা চাষ করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি আরও বলেন,
কৃষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফসল চাষাবাদে অভ্যস্ত করতে হবে। আমাদেরকে সয়াবিন থেকে বিদেশ-নির্ভরশীলতা কমাতে হলে যেভাবেই হোক সরিষার চাষ বাড়াতে হবে। আমাদানি নির্ভরতা কমাতে হবে।

পুষ্টিবিদ ইসরাত জাহানের মতে, বিভিন্ন ভোজ্য তেলের ওপর করা একটি তুলনামূলক সমীক্ষায় দেখা যায়, সরিষার তেল ৭০ শতাংশ হৃৎপিণ্ডসংক্রান্ত রোগের ঝুঁকি কমায়। সরিষার তেল ব্যবহারে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়, যা হৃদরোগের আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া সরিষা তেল ঠাণ্ডা ও কাশি উপশমে সহায়ক প্রমাণিত হয়েছে। যখন বুকে প্রয়োগ বা তার দৃঢ় সুবাস নিশ্বাসের মাধ্যমে নেয়া হয়, এটা শ্বাসযন্ত্রের নালির থেকে কফ অপসারণেও সাহায্য করে। শুধু খাওয়ার জন্যই নয়, সরিষার তেল চুল ও ত্বকের যত্নেও কাজে লাগে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহের পরিচালক ও গবেষণা ড. মো. আব্দুল মালেক মানবজমিনকে বলেন, বর্তমান বাণিজ্যিক কৃষিতে শস্যবিন্যাসে ফসলসহ এমন চাষাবাদ পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে যাতে সরিষা চাষে লাভ তুলনামূলকভাবে বেশি আসে। এক্ষেত্রে রোপা আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসে শূন্য চাষ পদ্ধতিতে রোপা আমন এবং বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে খুবই কম খরচে সরিষা আবাদ করে কৃষকগণকে লাভবান করা যেতে পারে। কারণ এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদে খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়। এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদে একর প্রতি রাসায়নিক সার প্রয়োগ, প্রয়োজনে একটি সেচ দেয়া এবং পাতা ও ফলের অল্টারনারিয়া ব্লাইট রোগ ও জাবপোকা দমনে বালাইনাশক প্রয়োগ এবং সরিষা সংগ্রহ ও মাড়াই বাবদ আনুমানিক ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। একরপ্রতি গড়ে ১২ মণ সরিষার ফলন প্রাপ্তিতে আয় হতে পারে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ বিনাচাষ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদ করে উৎপাদন খরচ বাদে একরপ্রতি প্রায় ১১ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। তিনি বলেন, বিনা চাষে সরিষা আবাদের মাধ্যমে দেশীয় সরিষার উৎপাদন তথা ফলন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে রাসায়নিক সার ও সেচ প্রয়োগ এবং বিভিন্ন আন্তঃপরিচর্যা বিষয়ে মাঠপর্যায়ে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাগণকে বিশেষ ভূমিকা পালনসহ সংশ্লিষ্ট সরিষা চাষাধীন এলাকায় কৃষক প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মাঠ প্রদর্শনী স্থাপনসহ মাঠ দিবসের আয়োজন করতে হবে।

সূত্র জানায়, চাহিদার তুলনায় ভোজ্য তেলের মোট দেশজ উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় প্রতি বছর ঘাটতি মোকাবিলায় বিদেশ হতে ভোজ্যতেল আমদানি করতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। দেশে ভোজ্যতেলের মূল উৎস হলো সরিষা এবং সামান্য পরিমাণে সূর্যমুখী, সয়াবিন ও তিল এবং রাইস ব্রান। এসব থেকে সর্বমোট ৫.০ লাখ টনের কাছাকাছি ভোজ্য তেল পাওয়া যায়। এ হিসাবে দেখা যায় দেশের প্রয়োজনীয় ভোজ্য তেলের ঘাটতি থাকে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ। বর্তমানে দেশে আবাদি জমির মাত্র ৪.০ শতাংশ তেলফসল আবাদে ব্যবহৃত হয়। এ বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত তেল ফসলের চাষাবাদ বৃদ্ধি এবং তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০২০ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়। বিভিন্ন জাতের সরিষার বীজে প্রায় ৪০-৪৪% তেল থাকে। বাংলাদেশে সরিষার তেলের উৎপাদনের বাৎসরিক পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ টন।

দেশে বর্তমানে চাষকৃত স্বল্প জীবনকালের রোপা আমন ধানের জাতসমূহ সংগ্রহের পর প্রচলিত পদ্ধতিতে জমি প্রস্তুত সরিষা চাষ করতে হলে জমি সম্পূর্ণ জো অবস্থায় আসার পর ভালোভাবে শুকিয়ে বীজ বপন করতে হয়, কারণ জো অবস্থায় আসার আগেই জমি চাষ দিলে এবং মাটির বেশি আর্দ্রতায় বীজ বপন করলে অঙ্কুরোদগম ঠিকভাবে হলেও পরবর্তীতে সরিষার বৃদ্ধি খুবই ধীর গতিতে হয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে এ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ করা সম্ভব হলেও নিচু এবং ভারি বুনটের মাটিতে আমন ধান সংগ্রহের পর মাটির আর্দ্রতা বেশি থাকায় জমিতে জো আসার পর চাষ দিয়ে সরিষা আবাদ করতে গেলে বিলম্ব হয় বিধায় সরিষা চাষ করা সম্ভব হয় না।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্যে দেখা যায় গত ২০১৮ সালে দেশে ৪৬.২১ লাখ টন ভোজ্য তেল আমদানিতে ২৭.৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যদিও আমদানিকৃত তেলের বড় একটি অংশ শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় বিগত কয়েক বছরে এই আমদানিহার পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম হারে ভোজ্য তেল প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *