ঈদের আগে যে কারণে বাড়ল সয়াবিন তেলের দাম

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


ঢাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে না পেয়ে ঢাকার গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে সয়াবিন তেল কিনতে এসেছেন আনোয়ার হোসেন। কিন্তু পুরো বাজার ঘুরে কোথাও সয়াবিন তেল পেলেন না। একজন বিক্রেতার সঙ্গে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমাদের এত বড় বাজার, তার কোথাও সয়াবিন তেল নেই, এটা কেমন কথা?’
আনোয়ার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘আমার বাসা নিকেতনে। সেখানকার কোন দোকানে সয়াবিন তেল নেই। তাই এখানে এলাম, কিন্তু এই বাজারেও নেই। সয়াবিন তেল নিয়ে আসলে হচ্ছে কী?’

শুধু তিনি একাই নন, বাজার ঘুরে সয়াবিন তেলের দেখা পাননি গ্রীনরোডের বাসিন্দা গৃহবধূ শাহানা পারভীনও। শনিবার থেকে মহল্লার কোনো দোকানে সয়াবিন তেল পাননি।

‘বাসায় আগের কেনা কিছুটা আছে, কিন্তু তাতে হবে না। ঈদের সময় তো অনেক রান্নাবান্না আছে। তেল না পেলে তো বিপদেই পড়ে যাবো।’

বিকল্প হিসাবে প্রায় দ্বিগুণ দাম দিয়ে তিনি দুই লিটার সূর্যমুখী তেল কিনে নিয়েছেন।

ঢাকার পলাশী, হাতিরপুল, কলাবাগান, মিরপুর-১০, মিরপুর-১ ও মোহাম্মদপুরের বাজারগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকার বাইরেও অনেক স্থানে সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি বলে জানা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও দাম অনেক বেশি নেয়া হচ্ছে।

দিনাজপুরে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না, তবে পলিব্যাগে বা খুচরা বিক্রি হচ্ছে, তবে দাম চড়া।

বরগুনার পাথরঘাটা থেকে মোহাম্মদ জামাল জানিয়েছেন, সেখানে ৭৬০ টাকা দামের পাঁচ লিটার তেলের বোতল বিক্রি করা হচ্ছে ১০০০ টাকায়। দিনাজপুরে বোতলজাত কোন সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না, তবে খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে। আবার চট্টগ্রাম ও খুলনায় সয়াবিন তেল ক্রেতারা কিনতে পারছেন বলে জানা যাচ্ছে।

ঢাকার সুপারস্টোর বা অনলাইন শপগুলোতেও সয়াবিন তেল নেই।
করে দাম নির্ধারণ করার পর সেই দফায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে।
এখন আবার ঈদের আগ মুহূর্তে ভোজ্য তেল নিয়ে হাহাকার তৈরি হয়েছে।

সয়াবিন তেল নিয়ে এই সঙ্কটের কারণ কী?
মুসলমানদের বড় উৎসব ঈদুল ফিতরের উপলক্ষে আগের কয়েক দিন ভোজ্য তেলসহ অন্যান্য উপকরণের চাহিদা বেড়ে যায়। বাংলাদেশে জনপ্রিয় ভোজ্য তেল সয়াবিন তেল এবার সেখানে বড় ঘাটতির তৈরি করেছে।

দেশে ভোজ্য তেলের ৮০ শতাংশ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ভোজ্য তেল সয়াবিন। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন করে বাজারে বিক্রি করে।

সয়াবিন তেল আমদানি, বিক্রি বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এই সঙ্কটের পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তার মধ্যে কিছু রয়েছে বাণিজ্যিক, আর কিছুটা মজুদের প্রবণতাকে দায়ী করা হয়েছে।

খুচরা বিক্রেতার বলছেন, তারা ডিলার বা মিল থেকে পর্যাপ্ত সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না। অন্যদিকে মিল মালিকদের দাবি, খুচরা বিক্রেতারা দাম বাড়ার আশায় মজুদ করে রাখছে।

খরার কারণে সয়াবিন উৎপাদন কমে গেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায়
বাংলাদেশে সয়াবিন তেল মূলত আমদানি করা হয় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে। কিন্তু সেখানে খরার কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে রাতারাতি বেড়েছে সয়াবিনের দাম।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের মূল্য দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। আগে টন প্রতি ৭৫০ ডলার করে খরচ পড়লেও এখন সর্বশেষ সেটি ১৮০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে পাম তেলের প্রধান রফতানিকারক দেশে ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় অন্য তেলের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।

আমরা যা খাই তার যতটুকু আমদানি করতে হয় যেসব দেশ থেকে
বাংলাদেশে ভোজ্য তেল হিসাবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সয়াবিন তেল। এই কারণে এই তেলের মূল্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সরকার নির্ধারণ করে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও এখনো পুরনো দামেই বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। এর বাইরে পাম অয়েল, সূর্যমুখী, জলপাই তেল বা সরিষার তেল ভোজ্য তেল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

তবে বাংলাদেশের অন্যতম আমদানি কারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘বিশ্ব বাজারে সয়াবিন তেলের দাম টন প্রতি ১৮৫০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু আমরা সরকারকে কথা দিয়েছিলাম, ঈদ পর্যন্ত প্রচলিত দামেই সাপোর্ট দিয়ে যাবো। সেটাই আমরা করছি। আমাদের মিল থেকে আমরা সয়াবিন বাজারে ছাড়ছি। কিন্তু হয়তো দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় খুচরা বিক্রেতারা সেটা মজুদ করে রাখতে পারেন।’

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন খুচরা বিক্রেতারা।

কাঁঠালবাগান এলাকার বিক্রেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘আমরা তো তেলই পাচ্ছি না, বিক্রি করবো কোথা থেকে। ডিলারও পাচ্ছে না যে, বিক্রি করার জন্য দেবে।’ সকাল থেকে অসংখ্য ক্রেতা তার দোকানে তেল খুঁজতে এসে ফেরত গেছেন বলে তিনি জানান।

তবে কাঁঠালবাগানেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কয়েকটি দোকানে সয়াবিন পাওয়া গেলেও তা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
লোকসান এড়াতে আমদানিকারকরা সয়াবিন তেলের আমদানি অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে এসেছেন। এ কারণে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সয়াবিন তেল আসছে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। এর পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার টন।

অতিরিক্ত চাহিদা?
সয়াবিন তেলের ডিলার ইসমাইল হোসেন বলছেন, ‘আগে আমরা যে পরিমাণ তেল পেতাম, গত দুই সপ্তাহ ধরে তার অর্ধেকের কম তেল এসেছে। আবার গত কয়েকদিন বোতলজাত তেল পাইনি বলা যায়। কিছু পলিব্যাগের তেল এসেছে, তাও আমরা বাজারে দিয়েছি। কিন্তু তারপরেও সবার চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারিনি।’

সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে আলোচনা করতে ঈদুল ফিতরের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী পাঁচই মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তেল আমদানিকারক, মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের এই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, সেখানে সয়াবিন তেলের মূল্য সমন্বয় করা হতে পারে।

ঈদের পরে দাম বেড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় খুচরা বিক্রেতারা যেমন একদিকে তেল মজুদ করছেন, আবার ক্রেতারাও অতিরিক্ত কেনার চেষ্টা করছেন।

বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন বলছেন, ‘অনেক ক্রেতার যেখানে এক বোতলে চলে, সেখানে দুই-তিন বোতল করে তেল কিনে নিয়ে গেছেন। ফলে বাজারের ওপরেও মারাত্মক চাপ তৈরি করেছে। একদিকে সরবরাহ কম, অন্যদিকে ক্রেতাদের বাড়তি কেনা, এই দুই মিলে সয়াবিনের এই সংকটের তৈরি হয়েছে।’

রমজান মাসে ভোজ্য তেলের বাড়তি চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আড়াই লাখ টন তেলের যোগান রাখার টার্গেট করা হয়েছিল বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
স্বাভাবিক সময়ে এক মাসে এই চাহিদা থাকে এক লাখ টন। রমজানে তেলের চাহিদা যা ধরা হয়, তার ৬৫ শতাংশই হচ্ছে পাম অয়েল।

এই পাম অয়েল আমদানির জন্য বাংলাদেশ মূলত ইন্দোনেশিয়ার ওপর নির্ভরশীল এবং ৮০ শতাংশই সেখান থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রফতানি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের ভোজ্য তেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।

অপরিশোধিত ভোজ্য তেল আমদানি করে তা দেশে আবার উৎপাদন করে যে মিলগুলো, সেই মিলগুলোর মধ্যে অন্যতম টি কে গ্রুপের পরিচালক সফিউল আথার তাসলিম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, মিলগুলোর বাইরে কোথাও সরবরাহে সঙ্কট সৃষ্টি করা হচ্ছে কিনা- এমন সন্দেহ তারা করছেন। ‘মিলগুলো থেকে সরবরাহ আগের মতোই আছে। বরং আমরা গত কয়েকদিনে অস্বাভাবিক চাহিদা দেখছি।’

‘যেমন একজন ডিলার আমার কাছ থেকে ছয়মাসে ভোজ্য তেল নিয়েছে ২০০ কার্টন। সে এখন এক দিনে এক সপ্তাহের জন্য চাচ্ছে ৫০০ কার্টন। এরকম অ্যাবনরমাল চাহিদা কিন্তু আমরা পাচ্ছি। আমরা কিন্তু কখনো ঈদের আগে এরকম পরিস্থিতি দেখি নাই,” বলেন সফিউল আথার তাসলিম।’
রোববার ঢাকার কাওরান বাজারে দুটি গুদামে অভিযান চালিয়ে দু’হাজার লিটার সয়াবিন তেল মজুদ শনাক্ত করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সয়াবিন তেল মজুদ করায় তিন ব্যবসায়ীকে জরিমানাও করা হয়েছে। সোমবারও ঢাকার একাধিক বাজারে অভিযান চালানো হয়েছে।

অধিদফতর মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলছেন, ‘যেখানেই হাত দিচ্ছি, সেখানেই অনিয়ম পাচ্ছি। মিল থেকে ঠিকই সাধারণ দামে তেল ছাড়ছে, কিন্তু অনেক বিক্রেতা সেটা মজুদ করে রাখছেন বা পরিচিত লোকজনের কাছে বিক্রি করছেন। আবার বলছে, বেশি টাকা দিলে পাওয়া যাবে। এটা তো তারা পারে না।’

তিনি জানান, তাদের একাধিক টিম বাজারে তদারকি করছে, যাতে কেউ তেল মজুদ করতে না পারে বা বাড়তি দামে বিক্রি করতে না পারে।

কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, ঈদের পরে বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের সাথে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যে বৈঠক করেছে, সেখানে মূল্য সমন্বয় করার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে।

বিশ্ব বাজারে বাড়ছে তেলের দাম
তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর বিশ্ব ভোজ্য তেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।

রোববার একটি প্রতিবেদনে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সূর্যমুখী তেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।

কারণ বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের বড় রফতানিকারক দেশ ইউক্রেন। ফলে সেখানে যুদ্ধের কারণে তেল সরবরাহ হুমকিতে পড়েছে। ফলে সারা বিশ্বে রাতারাতি বেড়েছে সূর্যমুখী তেলের দাম।

অন্যদিকে বিশ্বে সয়াবিন তেলের উপাদান সয়াবিন বড় রফতানিকারক দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেখানে খরায় এই বছর উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে বিশ্ব বাজারে সয়াবিনের দাম দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। ভারতের মতো কিছু দেশ বিকল্প হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ থেকে সয়াবিন আমদানি করার চেষ্টা করছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত সপ্তাহে পাম অয়েল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। সেটাও বাড়তি চাপ তৈরি করেছে অন্যান্য তেলের ওপরে।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত দুই মাসে বাড়তে বাড়তে সয়াবিন তেলের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে।

যুক্তরাজ্যে, স্পেন, গ্রিস, তুরস্ক এবং বেলজিয়ামের একাধিক সুপারমার্কেট চেইন ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, সবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ক্রেতারা যেন অতিরিক্ত ভোজ্য তেল না কেনেন। যুক্তরাজ্যের বড় সুপারমার্কেট টেসকো ক্রেতাদের জনপ্রতি তিন বোতলের বেশি ভোজ্য তেল বিক্রির সীমা বেঁধে দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *