ফ্যাট ভাঙতে ও ওজন কমাতে কার্যকর রোজা

Slider বিচিত্র

পেটের চর্বি এমন এক ধরনের চর্বি যা বার্ণ করা সবচেয়ে কঠিন। শুধু কম খাওয়া এবং শরীরচর্চা পেটের চর্বি কমাতে যথেষ্ট নয়। পেটের চর্বি কমাতে তিনটি পন্থা সহজেই পেটের ফ্যাট কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে। তার প্রথমটি হলো, রক্তে ইনসুলিন হরমোন লেভেল কমিয়ে রাখা, দ্বিতীয়টি হলো হাংগার হরমোন ঘ্রেলিন লেভেল কমিয়ে রাখা। তৃতীয়টি হলো, মেটাবলিক মেশিনারি তথা রেগুলেটরি হরমোন তথা থাইরয়েড হরমোন, অক্সিজেন অন্যান্য উপাদান কাজে লাগানো। ইনসুলিন এবং হাংগার হরমোন লেভেল কমা ছাড়া কখনো ফ্যাট বার্ণ সফল হবে না। এমন খাবার খেতে হবে যাতে রক্তে হাংগার হরমোন লেভেল কমবে এবং ফ্যাট বার্নিং হরমোন বাড়বে। ওজন কমাতে এবং পেটের চর্বি দূর করতে ফ্যাট বার্নিং মেশিনারিকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে হবে। আর ফ্যাট বার্নিং মেশিনারি তখনই কাজ করবে যখন রক্তে ইনসুলিন লেভেল কমে যাবে। এ ইনসুলিন লেভেল বেশি থাকলে শরীরের সর্বত্র ফ্যাট বার্নিং প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করবে। শুধু তাই নয়, ইনসুলিন আপনাকে ক্ষুধার্ত করে বেশি বেশি খেতে বাধ্য করবে।

তিনটি অত্যন্ত শক্তিশালী পদ্ধতি আছে যা ইনসুলিন লেভেলকে নামিয়ে দিতে বাধ্য করবে। প্রথমত, খাবারের পরিমাণ এবং কতবার খাবে তার সংখ্যা কমিয়ে দিতে হবে। কারণ যতবার যত বেশি খাবেন, ততবার তত বেশি ইনসুলিন কম বেশি নির্গত হবেই। দ্বিতীয়ত, চিনি খাওয়া শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। কারণ সুগার সবচেয়ে বেশি ইনসুলিন নির্গত করে। সুগার হলো মূলত ন্যাংটা ক্যালরির উৎস। পাশাপাশি এটি ড্রাগ অ্যাডিকশনের মতো যা বারবার খেতে ইচ্ছা করে। সুগার এর মধ্যে গ্লুকোজ যেমন ফ্রুক্টোজ তেমনি না খাওয়া উচিত। কারণ ফ্রুক্টোজ এলকোহলের মতো ফ্যাটি লিভার করতে পারদর্শী। ফ্যাটি লিভার মানে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হওয়া। তৃতীয়ত, মোটামুটি সব ধরনের কার্বোহাইড্রেট খাবারই কমিয়ে দিতে হবে বেশি ইনসুলিন সিক্রেশন কমানোর জন্য। আর বেশি ইনসুলিন সিক্রেশন মানে ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা, ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা মানে বেশি বেশি খাওয়া।

এবার আসি ক্ষুধা কিভাবে কমিয়ে আনা যায়। প্রথমত, এমন খাবার খেতে হবে যাতে ক্ষুধা লাগে কম। ক্ষুধা কমানোর সর্বোত্তম উপায় হলো কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে ফ্যাট-প্রোটিন উৎস থেকে এনার্জি নেয়া। খড়কুটার দাউ দাউ করা আগুন আর কাঠের ধীরে ধীরে জ্বলা আগুন এক নয়। দুটোই একই আগুন কিন্তু খড়কুটার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে নিমিষেই ছাই হয়ে যায় আর কাঠের আগুন অল্প অল্প করে জ্বললেও তা রান্নায় কার্যকর বেশি, কারণ কাঠের আগুন দীর্ঘস্থায়ী। তেমনি কার্বোহাউড্রেট থেকে পাওয়া এটিপি বা এনার্জি আর ফ্যাট থেকে পাওয়া এটিপি একই। কিন্তু পার্থক্য হলো কার্বোহাইড্রেট উৎসের এটিপি দ্রুত তৈরি হয়ে দ্রুত শেষ হয়ে যায় আর ফ্যাট উৎসের এটিপি তৈরি শুরু হয় দেরিতে কিন্তু থাকে অনেক সময় ধরে। দ্রুত শেষ হয়ে যায় বিধায় কার্বোহাইড্রেট খাবার খেলে দ্রুত ক্ষুধা লাগে আর তাই মানুষ খায় বেশি বেশি। অন্যদিকে ফ্যাট বা প্রোটিন জাতীয় খাবার আমরা খেতেও পারি কম এবং খেলে ক্ষুধাও লাগে কম ও দেরিতে।

দ্বিতীয়ত, এমন খাবার খেতে হবে যাতে ইনসুলিন কম সিক্রেশন হয়। দুই মানের খাবারে ইনসুলিন সিক্রেশন কম হয়। একটি হলো এমন খাবার, যাতে এনার্জি বার্ণ হয় আস্তে আস্তে। আরেকটি হলো এমন খাবার, যা ইনসুলিনের প্রতি বেশি নিউট্রাল। সবচেয়ে বেশি ইনসুলিন সিক্রেশন করে কার্বোহাইড্রেট খাবারে, তার চেয়ে কম প্রোটিন এবং সবচেয়ে কম ফ্যাট। গ্লুকোজের ইনসুলিন রেসপন্স ১০০% এবং দ্রুত, প্রোটিনের ইনসুলিন রেসপন্স গ্লুকোজের তুলনায় ১৫-৩০% এবং আস্তে আস্তে আর ফ্যাটের ইনসুলিন রেসপন্স সবচেয়ে কম এবং অনেক আস্তে আস্তে (৩-৪%)। ফ্যাটের মধ্যে হাই ফ্যাট বা উচ্চ-চর্বিযুক্ত খাদ্য হলো এমন একটি খাদ্য, যা মোট ক্যালোরির কমপক্ষে ৩৫% চর্বি থেকে গ্রহণ করা হয় যেখানে অসম্পৃক্ত ফ্যাটের পরিমাণ থাকে বেশি এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে অনেক কম।

লো ফ্যাট হলো তার উল্টোটা। কিন্তু সাধারণ মানুষের একটা প্রচলিত ধারণা হলো ফ্যাটজাতীয় খাবারে আপনাকে ফ্যাটি বানাবে। এ ধারণা সত্য কেবল লো ফ্যাট খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে। হাই ফ্যাট গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের স্লোগান হলো হাই ফ্যাট আপনাকে নাই ফ্যাট বানিয়ে ছাড়বে’। কারণ আনসেচুরেটেড ফ্যাট সেচুরেটেড ফ্যাটকে গলিয়ে দেয়। যে ফ্যাট খাবারে সেচুরেটেড ফ্যাট বেশি, আনসেচুরেটেড ফ্যাট অনেক কম আপনাকে মোটা বানাবে। হাই ফ্যাট খাবারে ইনসুলিন সিক্রেশন সবচেয়ে কম করাবে, বেশি ফ্যাট বার্ণ হবে, ফলে ক্ষুধা লাগবে অনেক কম। আর লো ফ্যাট খাবারে ইনসুলিন সিক্রেশন বাড়িয়ে দিবে, শরীরে ফ্যাট স্টোর গড়ে তুলে আপনাকে ফ্যাটি বানাবে, আর সবসময় ক্ষুধার্ত রেখে আপনাকে খাওয়াবে এবং আরো ফ্যাটি বানাবে। ফ্যাট সম্পর্কে অতি সাম্প্রতিক এ ধারণা পাশ্চাত্যের আধুনিক ধারণার বিপরীত। পাশ্চাত্যের ধারণায় হলো হাই কার্বোহাইড্রেট লো ফ্যাট ডায়েট। আর বর্তমান ধারণা হলো, হাই ফ্যাট লো কার্ব ডায়েট।

তৃতীয়ত, মেটাবলিক মেশিনারিকে কাজে লাগাতে হলে প্রথমেই মেটাবলিক রেগুলেটর থাইরয়েড হরমোনকে কাজে লাগাতে হবে। কারণ হাইপোথাইরয়েড কন্ডিশনে শরীরের সব ধরনের মেটাবলিক অ্যাক্টিভিটি কমে যায় ফলে মেটাবলিক কনভার্শনও কমে যাবে।
চতুর্থত, মেটাবলিক অ্যাক্টিভিটি বাড়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অক্সিজেন। কারণ ফ্যাট বার্ণ করতে কার্বোহাইড্রেটের চেয়ে অনেক বেশি অক্সিজেন লাগে। সুতরাং ভালো মতো ফ্যাট বার্ণ হয়ার জন্য সব ধরনের রক্তশূন্যতা দূর করতে হব। লাকড়ি ভালো না হলে যেমন আগুন জ্বলে না কেবল ধোঁয়া উড়ে, তেমনি পর্যাপ্ত অক্সিজেন না হলে ফ্যাট বার্ণ হতে পারবে না।

পঞ্চমত, মেডিয়াম চেইন ট্রাইগ্লিসারাইডস্ অথবা (এমসিটি) : এরা শর্ট চেইন হবার কারণে (৮-১০ কার্বন চেইন) দ্রুত শোষিত হয়ে দ্রুত ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করে কিন্তু ইনসুলিন স্টিমুলেট করে না।
ষষ্ঠত, আপেল সিডার ভিনেগার ফ্যাট মেটাবলিজমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, এটি ইনসুলিন সেনসিটিভিট বাড়িয়ে দেয়, অল্পাহারে তৃপ্তি নিয়ে আসে এবং পেটের চর্বি কমিয়ে দেয়।

সপ্তমত, প্রয়োজনীয় ভিটামিন যেমন, বি-ভিটামিন, পটাসিয়ামসমৃদ্ধ মিনারেল, ক্রমিয়াম যা ইনসুলিন সেনসিটিভি বাড়িয়ে দেয়।
অষ্টমত, প্রাইমারি ফ্যাট বার্নিং হরমোন গ্রোথ হরমোন লেভেল বাড়িয়ে ফ্যাট মেটাবলিজম বাড়ানো যায়। শরীর চর্চা এবং ফাস্টিংয়ের কারণে গ্রোথ হরমোন লেভেল বেড়ে যায়। পরিমিত ঘুম ফ্যাট ভাংতে সাহায্য করে। বিশেষ করে ঘুমানোর তিন ঘণ্টা আগে খাবার শেষ করে ঘুমালে তা ফ্যাট বার্ণিংয়ে অত্যন্ত কার্যকর। কিন্তু ভরা পেটে ঘুমাতে গেলে বেশির ভাগই বার্ণ হয় গ্লুকোজ।

নবমত, যখন পারেন হাটেন। হাটায় কর্টিসল হরমোন কমিয়ে ফ্যাট ভাংতে সাহায্য করে।
উপরোক্ত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, একমাত্র রোজা এমন একটি এবাদত যা একই সাথে ইনসুলিন ও ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল কমাতে, ফ্যাট ভাংতে এবং ওজন কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

দশমত, মেডিটেশন। এক মুহূর্তের জন্য খারাপ ভাবনা বা রাগারাগি করা মানে আপনার কর্টিসল লেভেল বাড়িয়ে দেয়া এবং ইমিইউন ফাংশন কমিয়ে দেয়া পরবর্তী ৮ ঘণ্টার জন্য। রমজানের রোজার দিনে এবং তারাবীহ নামাজের সময় যে একাগ্রতা মুসলিমরা বাধ্যতামূলকভাবে করে থাকে, তাতে প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম স্টিমুলেটেড হয় বলে শারীরিক এবং মানসিক প্রশান্তি অর্জিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *