এই মৃত্যুতে দায় কার?

Slider বিচিত্র

ভালোবেসে ডালিয়াকে বিয়ে করেছিলেন নাহিদ মিয়া। দীর্ঘদিনের প্রেমের পর সাত মাস আগে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। স্বপ্ন দেখেছিলেন বাবা-মা, ভাই ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার হবে। একদিন ঘর আলো করে আসবে তাদের সন্তান। ১৮ বছরের এই তরুণ অভাবের সংসারে অর্থের যোগান দিতে কাজ করতেন কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান হিসেবে। অল্প বেতনের বাইরে কিছু বকশিশও পেতেন। সেটি দিয়েই সংসার ও ছোট ভাইদের লেখাপড়ার খরচে বাবাকে সাহায্য করতেন। মঙ্গলবার পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও কাজে বের হন।

কিন্তু নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে আঘাত পান নাহিদ। দীর্ঘ সময় রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে ছিলেন। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে আইসিইউতে ভর্তি করেন চিকিৎসকরা। কয়েকঘণ্টা জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে প্রিয়তমা স্ত্রী, বাবা-মা ও আদরের ভাইদের রেখে বিয়ের মেহেদি রঙ মুছার আগেই পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। অথচ কথা ছিল কাজ সেরে বাসায় গিয়ে সবার সঙ্গে ইফতার করবেন। নাহিদ এখন শুধুই স্মৃতি। তার মৃত্যু এখন দেশজুড়ে আলোচনায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বমহলে একই প্রশ্ন, এই মৃত্যুর দায় কে নেবে? ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী না নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা। নাকি এই দায় রাষ্ট্র নেবে? এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। আদৌ হবে কিনা সেটি নিশ্চিত নয়।

কামরাঙ্গীচরের মধ্যে রসুলপুর এলাকার নাদিম মিয়া ও নার্গিস বেগমের বড় ছেলে নাহিদ মিয়া (১৮)। শরীফ (৭) ও ইব্রাহিম (৩) নামের আরও দুই ভাই আছে নাহিদের। একটি বোন ছিল কলেরায় মারা গেছে। নাহিদ লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। অভাবের কারণে আর বেশিদূর এগোয়নি লেখাপড়া। সংসারের হাল ধরতে ৮/৯ বছর বয়স থেকেই কাজে নামেন। শুরুতে নিউ সুপার মার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন। কিছুদিন কাজ করে সেটা ছেড়ে দেন। এরপর টুকটাক অন্য কাজ করছিলেন। তিন বছর ধরে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে এলিফ্যান্ট রোড এলাকার ডি লিংক নামের একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন। বেতনের বাইরে ডেলিভারির জন্য আরও কিছু বকশিশ পেতেন। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হন। স্ত্রী ও তার বাবা কাজে যেতে বাধা দেন। কারণ তারা জানতেন নিউমার্কেট এলাকায় ঝামেলা চলছে। কিন্তু নাহিদ বাবাকে বুঝায় অফিস থেকে ফোন করেছে তাই যেতে হবে। আর সামনে ঈদ। তাই টাকারও দরকার। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় স্ত্রী ও বাবাকে বলেছিলেন কাজ সেরে দ্রুত বাসায় ফিরবেন। সন্ধ্যায় একসঙ্গে ইফতার করবেন। বাসা থেকে বের হওয়ার দুই ঘণ্টা পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরিবারের সবাই তাকে ফোন দিচ্ছিলেন কিন্তু ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে তাদের আশা ছিল ইফতারের আগে বাসায় ফিরবে। সেজন্য সবাই মিলে অপেক্ষা করছিলেন। আসরের নামাজের পর থেকে তাদের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। কারণ একদিকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ অন্যদিকে বাসায়ও ফিরছে না। এই যখন অবস্থা তখন নাহিদের ছবি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেছে। নাহিদের বন্ধুরা এসে তার বাবাকে জানায় ফেসবুকের মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছে নাহিদ আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। তড়িঘড়ি করে নাহিদের বাবা হাসপাতালে এসে দেখেন তার অবস্থা খুবই খারাপ। তাই তাকে আগেই নেয়া হয়েছে আইসিইউতে। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তখনই বলেছিলেন তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। আর ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।
একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলের মৃত্যুতে পাগলপ্রায় নাহিদের বাবা নাদিম মিয়া। একটু পর পর কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন আর বলছিলেন, আমার মাসুম বাচ্চাটার কি দোষ ছিল? কেন তাকে মেরে ফেলা হলো। এখন আমি তার মা ও স্ত্রীকে কি জবাব দেবো? সরকারের কাছে আমি বিচার চাই। কাঁদতে কাঁদতে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে তিনি বলেন, আমি বাধা দিয়েছি ওদিকে না যেতে। ঝামেলা চলছে। বিপদ হতে পারে। আমার কথা শুনেনি। বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে অপেক্ষায় ছিলাম। রোজা রেখেই কাজে গিয়েছিল। কথা ছিল একসঙ্গে ইফতার করবো। তার বন্ধুরা দৌড়ে এসে আমাকে বলে নাহিদের অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে যেতে হবে। এসব বলতে বলতে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছেলের মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী ভাবছেন বা মামলা করবেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কার বিরুদ্ধে মামলা করবো। সরকার ভালো মন্দ যা বুঝে তাই করবে। মামলা করেতো আর ছেলেকে ফিরে পাবো না। বিনাদোষে ছেলেটা মরে গেল। সংসারের খরচের বড় একটি অংশ নাহিদ দিতো। এখন পরিবারের খরচ যোগানো কঠিন হবে। প্রিয়তম স্বামীর অকাল মৃত্যুতে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন ডালিয়া। চোখ খুললেই তার প্রশ্ন, তাকে কেন মারলো? তার অপরাধটা কী? এমনতো হওয়ার কথা ছিল না।
গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে নাহিদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে মরদেহ কামরাঙ্গীরচরের রনি মার্কেট সংলগ্ন মধ্য রসুলপুর দেওয়ান বাড়ির নিজ বাসায় নিয়ে কামরাঙ্গীরচর বড় মসজিদে জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে নাহিদ মিয়ার ময়নাতদন্ত করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ তার মৃত্যুর প্রধান কারণ। পুলিশ জানিয়েছে, তার মাথায় অন্তত চারটি আঘাতের চিহ্ন আছে। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন অংশে পেটানো হয়েছে।
নিউমার্কেট থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়াসিন কবির বলেন, নূরজাহান মার্কেটের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিলেন নাহিদ। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করে। ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। এখন চিকিৎসক জানিয়েছেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কোথায় আঘাত সে সম্পর্কে কিছু বলেননি তিনি।
এদিকে গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাহিদের কিছু ছবি ছড়িয়েছে। যেখানে দেখা গেছে নাহিদ পথচারী নন। বরং তিনি নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের হয়ে সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিলেন। দু’পক্ষের সংঘর্ষের সময় তিনি ব্যবসায়ীদের পাশের সম্মুখ অংশে ছিলেন। এ সময় তার গায়ে নীল রঙের একটি টি-শার্ট পরা ছিল। সেটিতে লিখা ছিল ইংরেজিতে ডি-লিংক। সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় এবং হাসপাতালের স্ট্রেচারে চিকিৎসা নেওয়ার সময়ও ওই টি-শার্ট তার গায়ে ছিল। ১২টা ৫০ মিনিটে তাকে ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *