ধৈর্য মানবজীবনের মহৎ একটি গুণ যা মানবজীবনের সফলতার চাবিকাঠি। ধৈর্যের অনুশীলন ছাড়া ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব। আনন্দ, ঝামেলা, দুঃখ ও উদ্বেগ ইত্যাদি সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আল্লাহ ও রাসূল সা: কর্তৃক নির্ধারিত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকাই হলো ধৈর্য। ধৈর্যের আভিধানিক অর্থ আনন্দ, প্রতিকূলতা, দুঃখ ও উদ্বেগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য ধারণ করো এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন করো। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাকো যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারো।’ (সূরা আলে ইমরান-২০০)
ধৈর্য ধারণ করা খুবই কঠিন কাজ তবুও সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য তা করা আবশ্যক। সমাজ জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও কল্যাণময় জীবনযাপনের জন্য ধৈর্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যধারণকারীদের বলেন, ‘হে আমার বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো। যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে পুণ্য। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।’ (সূরা আজ জুমার-১০)
মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ, সফলতা-বিফলতা, ভয়-পরাজয় আসবেই। তাই বলে সামান্য এই দুঃখ, বিপদ আর বিফলতায় পড়ে দুনিয়ার মায়ায় আটকে থাকা যাবে না। বান্দার মনে রাখতে হবে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের বেশি পরীক্ষা নেন। আর সেই বান্দা সফল হবে যে আল্লাহর পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করে।
একজন মুমিনকে অবশ্যই সুদিনের জন্য ধৈর্য ধারণ করতে হবে। তেমনি সুখশান্তি প্রাপ্তিতেও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে। ধৈর্যের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব এবং দুনিয়া ও আখিরাতের উপকারিতাগুলো দেখলে এটি ভালোভাবে বোঝা যায় যে, পবিত্র কুরআনে বহুবার আমাদের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
হজরত ইবরাহিম আ: যখন নমরুদের মূর্তিপূজার বিরোধিতা করলেন, তখন নমরুদ তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত করেছিলেন, কিন্তু তখন তিনি ছিলেন ধৈর্যশীল। তিনি একমাত্র তার রবের সাহায্য ব্যতীত অন্য কারো কাছে সাহায্যে চাননি। হজরত ইউসুফ আ: যখন জুলেখার ষড়যন্ত্রে আটকে গেলেন তখন তিনি একমাত্র তার রবের নিকট প্রার্থনা করেছিলেন।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: যখন আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারে অটল, মক্কার কাফির মুশরিকরা তখন দেখল যে প্রলোভন, ভীতি ও অকথ্য নির্যাতন তথা কোনো কিছুর মাধ্যমেই তাকে দমন করা যাচ্ছে না, বরং ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে হজরত মুহাম্মদ সা:কে সামাজিকভাবে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর তারা মহানবী সা: ও তার অনুসারীদের সাথে ওঠা-বসা, বেচাকেনা, লেনদেন এমনকি খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে অবরোধ আরোপ করল। এই দুর্দিনেও রাসূল সা: ধৈর্য হারাননি, বরং তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে সব সহ্য করে গেলেন। পরবর্তীতে কুরাইশরা নিজেদের ভুল বুঝে তাদের বর্জননীতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
শরিয়তের বিধান পালন করতেও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, রমজান মাসের সিয়াম পালন, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে হজ পালন, সম্পদ অর্জনের সাথে জাকাত প্রদান ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। ধৈর্যশক্তি বাড়ানোর আরেকটি উপায় উল্লেখ করা যায় তা হলো- অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা।
যেকোনো বিষয় আমাদের ভাবনা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী না-ও এগোতে পারে। আপনার প্রত্যাশা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক। ধৈর্য ও সাফল্য একটির সাথে আরেকটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মূলত মানুষ অতীত নিয়ে দুঃখিত, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং বর্তমান নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। সবর বা ধৈর্য আল্লাহর পরিপূর্ণ মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য।
আল্লাহ তায়ালা যাকে এই গুণ দেন, সে এই গুণে গুণান্বিত হয়। আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলদের এই বিরল গুণে ভূষিত করেছিলেন।
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন স্তরে ধৈর্যধারণের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সব বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করব। বিপদ মুক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করব। আমরা ধৈর্যশীল হবো।
ধৈর্য হচ্ছে মানুষের এমন একটি গুণ, যার কারণে সে অসুন্দর ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের একটি অন্তর্গত শক্তি, যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারে।
ধৈর্য বা সবরের ফল দুনিয়ার মধ্যেও পাওয়া যায়, আখিরাতেও পাওয়া যাবে। ধৈর্য ধরার উপকারিতা অনেক। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করবে এবং পরস্পরে কলহ করবে না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের হাওয়া (প্রভাব) বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে।’
আমাদের ধৈর্য ধারণ করার কোনো বিকল্প নেই, যদি আমরা দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে চূড়ান্ত সফলকাম হতে চাই।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা