র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কি প্রত্যাহার করানো যাবে?

সারাবিশ্ব


মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিঙ্কেনের সাথে বৈঠক করতে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল আমেরিকা যাওয়ার আগে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছিলেন, ওই বৈঠকে র‍্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।

ব্লিঙ্কেনের সাথে এ কে আব্দুল মোমেন ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠকটি হয়েছে বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার ভোররাতে (আমেরিকা সময় সোমবার দুপুর)। বৈঠকে র‍্যাবের নিষেধাজ্ঞার ইস্যুটি উঠেছে কি না তা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর কিছু জানায়নি।

তারা এক বিবৃতিতে শুধু বলেছে, ওই বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কে অর্থনৈতিক সম্পর্কের সম্ভাবনা, জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং শান্তিরক্ষীদের মাধ্যমে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

‘একটি সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে মানবাধিকার, আইনের শাসন, ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার ওপর পুনরায় গুরুত্বারোপ করেছেন সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন’ বলা হয়েছে বিবৃতিতে।

তবে মোমেন জানিয়েছেন, বৈঠকে র‍্যাবসহ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যায় অভিযুক্ত রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত পাঠানো, রোহিঙ্গা ইস্যু, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক, বিমান চলাচল ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই আলোচনা আর শুধু কথা দিয়ে কি র‍্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করানো যাবে?

র‍্যাব প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের এই সফরটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে।

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর র‍্যাব, পুলিশ প্রধান এবং র‍্যাবের বর্তমান ও সাবেক ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দফতর।

ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের তরফ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের সাথে বৈঠকের পর র‍্যাব ও কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটার জন্য তাদের একটা প্রসেসিং আমাদের কমপ্লিট করতে হবে।’

‘এই দেশে প্রায় জিনিসেই প্রসেস (প্রক্রিয়া) থাকে, ওই লোকগুলোকে, ওই কমিটিকে স্যাটিসফাইড (সন্তুষ্ট) করতে হবে। এটার জন্য কিছু সময় লাগবে। সুইচের মতো অন আর অফ করার মতো একদিনে করতে পারবেন না। আমাদের দেশের সরকার ইয়েস বললেই ইয়েস হয়ে গেল, কিন্তু এখানে ইয়েস সহজে-চাইলেও পারে না। প্রসেসগুলো শেষ করতে হবে।’

র‍্যাব সম্পর্কে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘র‍্যাব এমন সময়ে গঠিত হয়েছিল যখন সন্ত্রাস, জিহাদি, উৎপাত খুব বেশি ছিল। একদিনে ৪৯৫টা বোমাবাজি হয়। সারাদেশের মানুষ একটা আতঙ্কে ছিল। এই সময় (র‍্যাব) তৈরি হয়েছিল। র‍্যাব হয়তো কখনো কখনো এক্সেস (অতিরিক্ত) করে ফেলেছে। তবে (তাদের) ইনবিল্ট সিস্টেম আছে জবাবদিহিতার, এমনকি লাইফ এক্সিকিউশনও (মৃত্যুদণ্ড) হয়েছে। সেখানে জবাবদিহিতা আছে। এমনকি আপনাদের রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি বলেছিলেন, র‍্যাব হচ্ছে ইউএসএ-র এফবিআইয়ের মতো একটা প্রতিষ্ঠান। আর সেই প্রতিষ্ঠানকে আপনারা নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় ইয়াং লোকজন ওখানে চাকরি করতে অনাগ্রহী হবে।’

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথোপকথনের বিস্তারিত তুলে ধরে মোমেন বলছেন, তিনি তাকে বলেছেন, ‘আপনারা এটা পুনর্বিবেচনা করলে খুব খুশি হবো। উনি বললেন, একটা প্রসেস আছে, প্রসেসে হবে। কিন্তু আমরা অ্যাকাউন্টিবিলিটি চাই। আমরা এই ব্যাপারে খুবই সোচ্চার। আমি বললাম, অফকোর্স। আমরা প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিয়েছি। তখন বললেন, হ্যাঁ, গত চারমাসে কেউ মারা যায়নি। আমি বললাম, ডিএসএ (ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) আমাদের ট্রাক রেকর্ড ইজ ভেরি গুড। গত চার মাসে একটা লোকও ডিএসএ-তে অ্যারেস্ট হয় নাই। তিনি বলছেন, এটা ভালো, আমার এ নিয়ে কাজ করবো।’

নিষেধাজ্ঞার কী হবে?
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রিয়াজ মনে করেন, শুধুমাত্র আলোচনা বা অনুরোধের মাধ্যমে বাংলাদেশের র‍্যাব বা কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কোনো পরিবর্তন আসবে না।

অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলছেন, ‘নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে সেটার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষে আলাদা করে হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। এটা একটা প্রক্রিয়ার বিষয়। এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত আছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ এবং যে সমস্ত অভিযোগ উঠেছে, সে সমস্ত অভিযোগের ব্যাপারে এক ধরনের ধারণা তাদের আছে। তারা সেটা নজরদারিতে রেখেছে। আমার জানা মতে, র‍্যাবের সাথে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যুক্ত আছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর, গণতন্ত্রের বিষয়, মত প্রকাশের অধিকারের প্রশ্ন এবং আগামী নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয়-সে বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের নজর রয়েছে।’

গত বছরের ডিসেম্বর মাসে র‍্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে র‍্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬০০-রও বেশি লোকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ি।

কিছু রিপোর্টে আভাস পাওয়া যায় যে এসব ঘটনায় বিরোধীদলীয় সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের টার্গেট করা হয়েছে-বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

এতে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার’ অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং এর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথা বলা হয়।

এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় র‍্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ-আইনের শাসন, মানবাধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা, ও বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে হেয় করার মাধ্যমে-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলছে।’

ফলে শুধুমাত্র এই আলোচনার মাধ্যমে সেসব বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে, সে রকম কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না মার্কিন গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক আলী রিয়াজ।

তিনি বলছেন, ‘বিশেষ করে র‍্যাবের বিষয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব অভিযোগ তুলছিলেন। সুতরাং র‍্যাবের বিষয়ে কিছু সংস্কার করতে হবে, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে এবং অন্যান্য যে সমস্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আচরণের ব্যাপারে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এর বাইরে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে খুব বেশি অগ্রসর হওয়া যাবে বলে মনে করি না।’

র‍্যাব ও ছয় কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অধ্যাপক আলী রিয়াজ।

‘এখানে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িত রয়েছে। কিন্তু এখানে বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্রের প্রশ্নও জড়িত রয়েছে। আর তৃতীয় বিষয় রয়েছে, প্রতিষ্ঠান হিসাবে র‍্যাবের আচরণের বিষয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলোরও সংশোধন করতে হবে,’ বলছেন আলী রিয়াজ।

সাউথ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করা বা প্রত্যাহার করার নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে। কিন্তু এর মধ্যে কতটুকু রাজনৈতিক আর কতটুকু সত্যিকারের বিষয় আছে, সেটাও দেখতে হবে।’

কিন্তু এর সাথে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ইস্যুও জড়িত রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেবার ইস্যুটিকে বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার একটি ‘চাপ সৃষ্টি’র কৌশল।

এর পেছনে চীন ও রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক, কোয়াড নামের এক মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশের যোগ না দেয়া-এমন নানা কারণে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি বদলের একটি যোগসাজশ রয়েছে বলে তারা মনে করেন।

অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান বলছেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি দেখা যাচ্ছে। এশিয়া ও সাউথ এশিয়ায় চীনের ভূমিকায় আমেরিকা চিন্তিত হয়েছে। কিন্তু এটাও বলা যায়, বাংলাদেশে যেভাবে র‍্যাবের গোলাগুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছিল, গত আড়াই বা তিন মাসে এটা একেবারে শূন্যে নেমে এসেছে। আমরা এখনো জানি না, মানবাধিকার রক্ষায় তারা কী ভূমিকা পালন করে। আমার কাছে মনে হয়, আমেরিকা যে ভূমিকা নিয়েছে, তার বড় কারণ আমাদের দেশে গণতন্ত্রের যে একটা ক্রাইসিস বা চ্যালেঞ্জ চলছে, সেটা তারা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

তিনি বলছেন, ‘শুধু অনুরোধে কিছু হবে না। আমরা কাজে কি করছি, সেটা তারা দেখবে। বিশেষ করে আগামী বছরে যে নির্বাচন হবে, সেখানে সরকার গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দেয় কি না, সেগুলো তাদের নজরদারি থাকবে। সুতরাং অ্যাকশন না হলে শুধুমাত্র কথা বলে বা মিটিং করে কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *