অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড প্রশ্নের মুখোমুখি পুলিশ

Slider বাংলার মুখোমুখি

65702_ovi

শাহবাগ থানা থেকে দুরত্ব দুইশ’ গজ। ঘটনাস্থলের কাছেই ছিল পুলিশের নিরাপত্তা টহল দল। গ্রন্থমেলার ফটক ঘিরে আরও কয়েক স্থানে ছিল পুলিশের অবস্থান। সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের নিয়মিত টহল দলের অবস্থানও ছিল আশপাশের সড়কে। এমন নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই ব্লগার অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর তারা নির্বিঘ্নে এলাকা ত্যাগ করলেও কোথাও কোন বাধার মুখে পড়েনি। পুলিশ কর্তারা জানিয়েছেন, ওই এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা টহল ছিল। তাহলে কিভাবে খুনিরা নির্বিঘ্নে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটালো- এমন প্রশ্নের মুখোমুখি পুলিশ। এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কোন ক্লু উদঘাটনের খবর জানাতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের দুই ঘণ্টার মধ্যেই আনসার বাংলা-৭ নামের একটি সংগঠন দায় স্বীকার করে বলে পুলিশ দাবি করেছে। তবে এর আগে এই সংগঠনের অস্তিত্বের কথা জানা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী, নিহতের স্বজন, ব্লগার ও বিভিন্ন সংঠনের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, ঘটনাস্থলের ৫০ গজ দূরেই দায়িত্ব পালন করছিল পুলিশ। সেখানে ছিল পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান। হামলার শিকার হয়ে অভিজিৎ ও তার স্ত্রী বন্যা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে যাননি। ঠাণ্ডা মাথায় দুর্বৃত্তরা অভিজিতের মৃত্যু নিশ্চিত করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়।
গতকাল সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, রক্তের দাগ লেগে আছে ফুটপাতে, রাস্তায়। সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অনেকে। ঘটনাস্থলটি রাজু ভাস্কর্য থেকে ২৫ গজ দূরে উত্তর দিকে সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাত। প্রায় ২০০ গজ দূরে শাহবাগ থানা। ঘটনাস্থলের পাশেই গ্রন্থমেলা উপলক্ষে পুলিশের ব্যারিকেড। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী সেখানে প্রহরায় ছিল পুলিশ। গ্রন্থমেলামুখী সব লোককে এখানে দেহ তল্লাশি করে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। ঘটনাস্থল দিয়ে প্রতিদিন হাজার-হাজার মানুষ গ্রন্থমেলায় আসা-যাওয়া করেন। টিএসসিতে বসে আড্ডা দেন তরুণ-তরুণীরা। গ্রন্থমেলা ছাড়াও বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই এলাকাটি নিরাপত্তা বলয়ে থাকে। গ্রন্থমেলা উপলক্ষে তা আরও জোরদার করা হয়েছে। এমন নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই নির্বিঘ্নে অভিজিৎকে হত্যার ঘটনায় স্তব্ধ খোদ পুলিশ কর্মকর্তারা। এ ঘটনাকে ঘিরে প্রশ্নের জবাব মিলছে না তাদের কাছে।
অভিজিৎ হত্যার পরপরই তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ঘটনার পরপরই আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলের আশপাশের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হামলাকারীরা পেছন দিক থেকে অভিজিৎকে কোপাতে থাকে। এ সময় অভিজিৎকে রক্ষা করার জন্য বন্যা এগিয়ে গেলে তার ওপর হামলা চালানো হয়। দুষ্কৃতকারীদের চাপাতির আঘাতে বন্যার একটি আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ততক্ষণে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন অভিজিৎ। রক্তে ভেসে যায় ফুটপাত। তার মাথা থেকে মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সেখানে। অভিজিৎ মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার পর দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে যায়। তখন চিৎকার করে লোকজনের সাহায্য চান বন্যা। আশপাশে কিছু লোক জড়ো হলেও তারা নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমনকি পাশে দায়িত্ব পালনরত পুলিশও প্রথমে বন্যার চিৎকারে সাড়া দেয়নি। এভাবে কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর একজন আলোকচিত্রীসহ কয়েকজন এগিয়ে যান। তাদের সহযোগিতায় অভিজিৎ ও বন্যাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রন্থমেলার তখন টিএসসি ব্যারিকেডের দায়িত্ব পালন করছিলেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়াহিদুজ্জামান। ওয়াহিদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, আমরা (পুলিশ সদস্যরা) তখন গ্রন্থমেলার দায়িত্ব পালন করছিলাম। আমাদের অবস্থান ছিল গ্রন্থমেলার টিএসসি ব্যারিকেডে। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। একপর্যায়ে চিৎকার শুনে এগিয়ে যাই। ততক্ষণে কয়েক ব্যক্তি আহতদের সহযোগিতা করে সিএনজি অটোরিকশাযোগে হাসপাতালে নিয়ে যান। এসআই ওয়াহিদুজ্জামান জানান, ঘটনা বুঝতে পেরে ওই অটোরিকশার পেছনে- পেছনে হাসপাতালে যান তিনি।
এ বিষয়ে রমনা জোনের সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান বলেন, অনেক সময় জনসমাগম এলাকায় টার্গেট ওরিয়েন্টেড কিলিং এ অংশ নেয়াদের হাতেনাতে ধরা কঠিন হয়ে যায়। ঘটনার পরপরই পুলিশ ও ডিবি পুলিশসহ র‌্যাব ও সিআইডি তদন্ত শুরু হয়েছে। বিভিন্নস্থানে অভিযানও চলছে বলে জানান তিনি। নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে মন্তব্য করে শিবলী নোমান বলেন, এটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর কাজ।
তদন্তে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা মনে করেন, কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীরা প্রশিক্ষিত ছিল। যে কারণে জনসমাগম এলাকায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে তারা নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। বৃহস্পতিবার গ্রন্থমেলায় যাওয়ার পর থেকেই দুষ্কৃতকারীরা তাকে অনুসরণ করছিল বলে তারা মনে করেন। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে তার উপর হামলা চালায়। মূল কিলিংয়ে দুই জন অংশ নিলেও পরোক্ষভাবে আরও কয়েকজন ছিল হত্যা মিশনে। ঘটনাস্থলের আশপাশেই তারা অবস্থান নিয়েছিল। এসব বিষয়কে সামনে রেখেই তদন্ত শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম জানান, প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা জঙ্গিরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আনসার বাংলা সেভেন নামের একটি গ্রুপ টুইটারে এ হত্যাকাণ্ডকে নিজেদের বিজয় বলে দাবি করেছে। এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। তিনি জানান, প্রত্যক্ষদর্শীরা তেমন কোন তথ্য দিতে পারেনি। তবে সেলিম নামে এক ফুল বিক্রেতা পুলিশকে জানিয়েছেন, কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী দুজন মধ্যে একজনের পরনে সাদা শার্ট, অন্যজনের পরনে ছিল কোট। তাদের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছর হবে। অত্যন্ত ক্ষীপ্রতার সঙ্গে অভিজিৎকে কুপিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা স্থান ত্যাগ করে। প্রত্যক্ষদর্শী সেলিম চিৎকার করেন। এ সময় হামলাকারীরা তার দিকে তেড়ে গেলে তিনি ভয়ে পালিয়ে যান। অভিজিৎকে হত্যার দুই ঘণ্টার মধ্যেই আনসার বাংলা-৭ নামের টুইটার একাউন্ট থেকে অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে। টুইটার বার্তায় লেখা আছে, ‘জয় নোজ নো বাউন্ডস, ভিআইপি টার্গেট ইজ ডাউন ইন ঢাকা।’ এবং ‘আল্লাহু আকবর.. বাংলাদেশে আজ একটি বিশাল সাফল্য। টার্গেট ইজ ডাউন..।’ ‘আনসার বাংলা ৭’ নামের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ওই টুইট করার পর হত্যার দায় স্বীকার করে আরও বেশকিছু টুইট করা হয়। ওইসব টুইটে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডকে ‘বিজয়’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। ‘আনসার বাংলা ৭’ নামের সংগঠনকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সহযোগী বলে মনে করছে পুলিশ। যদিও এ নামের কোন সংগঠনের অস্থিত্বের বিষয়ে আগে শোনা যায়নি।
অভিজিতের বন্ধু ও তার একাধিক বইয়ের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল জানান, প্রগতিশীল এই লেখককে বিভিন্ন সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। ঘটনার দিন স্ত্রী বন্যাকে নিয়ে বইমেলায় যান অভিজিৎ। সেখানে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন শেষে বের হলেই এ ঘটনা ঘটে। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি বইমেলা উপলক্ষে দেশে ফিরেন অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী বন্যা। তাদের ধারণা, দেশে ফেরার পর থেকেই অভিজিৎকে টার্গেট করছিল দুষ্কৃতকারীরা। ব্লগে ধর্ম, বিশ্বাস, বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির কারণে তার ওপর একটি মহল ক্ষুব্ধ ছিল। তারা বিভিন্ন সময়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। যে কারণে অভিজিৎকে নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। অভিজিৎ দেশে থাকুক, এটা চাইতেন না তার পরিবারের লোকজন। অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, আমি অভিজিৎকে বলেছিলাম- তোমার মতো মানুষের জন্য এই দেশ সুখকর না। আমি যে আশঙ্কা করেছিলাম শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। ওরা আমার ছেলেকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করলো। সরকার চাইলেই খুনিদের গ্রেপ্তার করতে পারে বলে মনে করেন অজয় রায়। তিনি বলেন, খুনি কারা তা সবাই জানে। জঙ্গিগোষ্ঠীরাই অভিজিৎকে হত্যা করেছে। তাদের সব নথিপত্র পুলিশের কাছে রয়েছে। সরকার চাইলেই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে পারে। এ ঘটনায় অজয় রায় বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক সুব্রত জানান, মামলায় অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে দুর্বৃত্তদের ফেলে যাওয়া চাপাতি ও একটি ব্যাগ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আলমত ও বিভিন্ন সূত্রধরে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। হত্যাকারীরা যে চাপাতি ব্যবহার করেছে তার বাট কাগজ দিয়ে মোড়ানো ছিল।
শুক্রবার অভিজিতের লাশের ময়নাতদন্ত করেছেন ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, অভিজিৎ রায়ের মাথার ডান পাশে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ধারাল অস্ত্রের তিনটি আঘাত রয়েছে। আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। একটি আঘাত থেকে আরেকটি আঘাতের দূরত্ব আধা ইঞ্চি, সবগুলোই সমান্তরাল। একটি আরেকটির ওপর পড়েনি। ওই আঘাত এতই মারাত্মক ছিল যে চামড়া ও হাড় কেটে একেবারে মগজে পৌঁছেছে। এছাড়া পিঠে ও বাঁ চোখের ভ্রূর কাছে জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার রাতে হামলার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাতে সাড়ে ১০টায় মৃত্যু হয় অভিজিৎ রায়ের। এ ঘটনায় গুরুতর আহত অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বন্যাকে ঢামেক হাসপাতাল থেকে স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তরের পর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানান। অভিজিতের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, শ্রদ্ধা জানানোর পর তার ইচ্ছা অনুযায়ী মরদেহ ঢাকা মেডিক্যালে দান করা হবে শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য।
গত আট বছর যাবৎ পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন অভিজিৎ রায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ড. অজয় রায়ের পুত্র। দেশে এলে তিনি তার পিতার বাসা বড় মগবাজারের ইস্টার্ন হাউজিংয়ে এবং মামার বাসা ইন্দিরা রোডে থাকতেন। তিনি মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা। সেই সঙ্গে বিজ্ঞান, বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়ে লেখালেখি করতেন তিনি। সমপ্রতি শূন্য থেকে মহাবিশ্ব ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পে নামে তার দুটি বই প্রকাশ হয়েছে।
এদিকে, শুক্রবার দিনভর লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যা ও ব্লগার রাফিদা বন্যার ওপর হামলার প্রতিবাদে ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভেস্ট, গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন শাহবাগে মিছিল ও সমাবেশ করেছে। খুনিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা না হলে এর দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে বলে জানান তারা। একই সঙ্গে এ হামলার জন্য মৌলবাদী শক্তির তৎপরতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততাকেও দায়ী করা হয়।
ঢাবিতে দিনভর বিক্ষোভ, প্রতিবাদ
বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের নৃশংস হত্যকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল দিনভর প্রতিবাদ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশসহ এসব কর্মসূচি পালন করে। সমাবেশে বক্তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সুরক্ষিত এলাকায় এ হত্যাকণ্ডের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এর দায় সরকারকেও নিতে হবে। একই সঙ্গে ধর্মাশ্রয়ী জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে সারা দেশে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহ্বান জানানো হয়। সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন ‘আক্রান্ত মুক্তচিন্তা’- শিরোনামে প্রতিবাদী ছাত্র-শিক্ষক-নাগরিকরা। সমাবেশে লেখক অভিজিৎ হত্যা ও ব্লগার রাফিদা বন্যার হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের পরিচালনায় সমাবেশে বিশিষ্টজনরা বক্তৃতা করেন। লেখক ও কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় যেভাবে দেশের প্রগতিশীল মানুষদের হত্যা করা হয়েছিল, হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করেছে তারই ধারাবাহিকতায় অভিজিৎকে হত্যা করা হয়। এর মাধ্যমে দেশে প্রগতিশীল মানুষের প্রতিনিধিকে হত্যা করা হয়েছে। এখন সময় এসেছে শপথ নেয়ার, যাতে প্রতিশীল আন্দোলন হারিয়ে না যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, মুক্তচিন্তা ধারণাটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। হত্যা করে এর অগ্রগতি বন্ধ করা যাবে না। আনসারউল্লাহ বাংলা টিম বাংলাদেশকে কুয়োর ব্যাঙ বানাতে চায় বলে তিনি মন্তব্য করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এজেএম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, যারা বাংলাদেশকে বাংলাস্তান বানাতে চায় তারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির বলেন, যারা অভিজিৎকে হত্যা করেছে তারা লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। একুশে গ্রন্থমেলায় মানুষের ভিড়ে কুপিয়ে মারার সাহস তারা কোথায় পায়? হত্যাকারীরা প্রগতিশীল, মুক্ত এবং জনগণের বাংলাদেশ চায় না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর রাণা দাশ গুপ্ত বলেন, সাঈদীর রায়ের পর ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে সাধারণ মানুষ এবং সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালানো হয়েছে। দেশে গৃহযুদ্ধ বাধানোর জন্য জঙ্গিরা এ হত্যকাণ্ড ঘটিয়েছে। তিনি পুলিশের কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যেসব পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের অদূরে দায়িত্বে ছিল তারপরও অভিজিৎ ও তার স্ত্রীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ক্ষুদ্রস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী বলেন, কার কাছে নিন্দা জানাবো? কার কাছে বিচার চাইবো? তারা কি বিচার করবেন? গ্রন্থমেলায় আমরা প্রকাশকরা প্রবেশের সময় বারবার সার্চ করা হয়। কিন্তু এত নিরাপত্তার মধ্যেও কিভাবে দু’জন ঘাতক অস্ত্রসহ হামলা চালালো বুঝে আসে না। সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, যারা ঘাতক তাদের প্রতি ঘৃণা তো রয়েছেই পাশাপাশি যারা বিচার অসমাপ্ত রেখে তাদের সুযোগ করে দিয়েছেন তাদের প্রতিও ঘৃণা জানাচ্ছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন তা সম্পন্ন করতে পারলে হত্যাকারীরা এত সাহস পেতো না।
তিনি বলেন, গ্রন্থমেলা জুড়ে পুলিশের স্তরের পর স্তর নিরাপত্তা রয়েছে। সে স্তরের মধ্যে কিভাবে অস্ত্রসহ ঘাতকরা আসে এবং পুলিশ সে সময় কি করছিল তার জবাব পুলিশের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। কামাল লোহানী বলেন, এদেশের মানুষ যেমন মরতে জানে তেমনি মারতেও জানে। তিনি দেশের সকল প্রগতিবাদী মানুষকে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে হামলাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেক বলেন, অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব ঘটনার কোন বিচার হয় না। প্রচার রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রাজধানীর সবচেয়ে নিরাপদ এলাকা। এখানে সার্বক্ষণিক পুলিশের পাহারা থাকে। পাশাপাশি একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরাও পাহারা বসায়। এর মাঝেও মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় সরকারের সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেয়ার কথা ফাঁকা বুলি। তিনি বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যেন সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এটিও হারিয়ে না যায়। তিনি এ ঘটনার জন্য ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করেছেন।
গণসংহতি আন্দোলনের আহ্বায়ক জুনায়েদ সাকী বলেন, বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড হয় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, ক্ষমতায় থাকার জন্য। পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে সরকার জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারে না। একমাত্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই নিরাপত্তা দিতে পারে। সমাবেশ শেষে রাত ১০টা পর্যন্ত সেখানে প্রতিবাদী গান পরিবেশ করে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মী ও বিক্ষুব্ধরা। সন্ধ্যায় হত্যাকারীদের দ্রুত চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার জন্য প্রগতিশীল ছাত্রজোট কর্মসূচি ঘোষণা করে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আজ সকাল থেকে কালো ব্যাজ ধারণ, বেলা ১২টায় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী মিছিল ও দুপুর ১টায় মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট। দোষীদের আটক ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মশাল মিছিল করেছে ছাত্রলীগ, গণজাগরণ মঞ্চ ও প্রগতিশীল ছাত্রজোট। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের স্থানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
গণজাগরণ মঞ্চের লাগাতার অবস্থান: এদিকে লেখক ও ব্লগার অভিজিতের হত্যার প্রতিবাদে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছে মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার পক্ষ। অভিজিৎ এর হত্যাকারী ও পরিকল্পনাকারীরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ডা. ইমরান। গতকাল সকাল ১০টা থেকে এ অবস্থান শুরু হয়। এ সময় ডা. ইমরান বলেন, যারা অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে তারা আত্মস্বীকৃত মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জঙ্গি ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, একই ধরনের ঘটনা বার বার ঘটছে। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক শফিউল, ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর গতকাল অভিজিৎকেও হত্যা করা হলো। অথচ হত্যাকারী জঙ্গিগোষ্ঠীর কোন বিচার হচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *