ঢাকা: করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন রোধে সরকার যে বিধিনিষেধের কথা চিন্তা করছে, সেটা তেমন কোনো সুফল দেবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। লকডাউনের মতো আত্মঘাতী বিধিনিষেধ আরোপের সময় এখনও হয়নি বলে জানান তারা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে করোনা সংক্রমণ যে হারে হচ্ছে, তাতে এখনই লকডাউনের মতো আত্মঘাতী কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সময় হয়নি। দুই বছর পর মাত্র অর্থনীতি সচল হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে আবার করোনা বাড়ছে। তাই অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। যদি আক্রান্তের হার বাড়তে থাকে তখন বিচার বিশ্লেষণ করে বিচক্ষণতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সরকার যে বিধিনিষেধের কথা চিন্তা করছে, সেটা তেমন কোনো সুফল দেবে না। করোনা রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। তবে এখন সরকার কতটা কঠোর হতে পারবে বলা যাচ্ছে না। কারণ অতীতে সেটা আমরা দেখতে পাইনি।
তিনি বলেন, বিধিনিষেধে সামাজিক অনুষ্ঠান সীমিত করা, খাবারের হোটেল ও মার্কেট-শপিংমলের সময় কমিয়ে কখনো করোনা রোধ করা যাবে না। হয় একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে নয়তো যেভাবে আছে সেভাবেই চলতে দিতে হবে। কারণ সময় কমিয়ে আনলে একসাথে অনেক চাপ পড়ে যায়। তখন বরং করোনা আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে বেশি। আর করোনা আক্রান্তের ফলে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, এমন যদি হতো তাহলে সময় কমিয়ে আনাটা একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতো। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। আমরা আমাদের দেশে যেভাবে থাকি তাতে সংক্রমণ হবেই, সেটা ঠেকানো সম্ভব না। একটি পাবলিক বাসে উঠলে সকলেই ঝুঁকিতে থাকে। মূলত আমরা সবাই যখন আক্রান্ত হবো তারপর এমনিতেই চলে যাবে করোনা।
লকডাউনের সময় হয়নি উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, কোনো লকডাউনে আমরা কোনো সুফল পাইনি। মানুষ লকডাউন মানে না, প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। এখন ওমিক্রন যেভাবে ছড়াচ্ছে সেটার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো আক্রান্তদের কীভাবে হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। এছাড়া মানুষের মৃত্যুর হার কীরকম হচ্ছে, সেটা দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া। সেটা না দেখে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে সেটা যৌক্তিক হবে না। আর লকডাউনে অর্থনৈতিক ক্ষতি বেশি হয়। তাহলে সে ক্ষতি আমরা কেন ইচ্ছা করে ডেকে নিয়ে আসবো? সে জন্য দেখতে হবে সংক্রমণের হার কীরকম, সেটা না দেখে লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপ করা ঠিক হবে না।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, দেশে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলছে, সব ধরনের আচার-অনুষ্ঠান চলছে, সে ক্ষেত্রে দোকানপাট, শপিংমলে বিধিনিষেধ আরোপ করে লাভটা কী হবে? তারপরও আমাদের কোনো আপত্তি নেই, সরকার যে নিদ্ধান্ত নেবে আমরা মেনে নেবো। তবে এ মূহূর্তে ওমিক্রন সে হারে বাড়েনি। যদি সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পায় তাহলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত এলে যৌক্তিক বলে মনে হবে। বিভিন্ন কমিটি যে সুপারিশ করেছে সেটা আমিও দেখেছি। সেখানে মার্কেট শপিংমল খোলা রাখার সময় ২ ঘণ্টা কমিয়ে আনতে বলেছে। এতে করে মার্কেটগুলোতে একসাথে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ে, সাথে সাথে ওমিক্রন আক্রান্তের হারও বৃদ্ধি পাবে। যদি দীর্ঘ সময় থাকে তাহলে মানুষ দেখে শুনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পণ্য কিনতে পারে।
তিনি বলেন, যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটা আমার কাছে মনে হয় আত্মঘাতী। গত দুই বছরে মানুষ বুঝে গেছে করোনা হলে কী করতে হয়। মানুষ অনেক সচেতন হয়ে গেছে। বাজারঘাট, দোকানপাট দীর্ঘ সময় খোলা থাকলে তেমন কোনো অসুবিধা হবে বলে আমি মনে করি না। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে জেল-জরিমানা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হাসেম বলেন, করোনাভাইরাস আবার বাড়ছে। আমাদের এই ভাইরাস সম্পর্কে অনেক ধারণা হয়েছে। করোনার অজুহাতে যদি সরকার আবার সবকিছু বন্ধ করে দেয় তাহলে সেটা হবে আত্মঘাতী। কারণ ২০২০ সালে দেওয়া লকডাউনে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমরা বুঝে গেছি করোনা সহসা পৃথিবী থেকে যাচ্ছে না। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রেখে যতটুকু করা যায় সরকারকে সেটা করতে হবে। বিশেষ করে সাধারণ জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। তবে লকডাউনের সময় এখনও হয়নি। আর সবকিছু সীমিত আকারে খোলা রাখলে যা হয় দীর্ঘ সময় খোলা রাখলেও তাই হবে। হয় একেবারে সব কিছু বন্ধ করে দিতে হবে নয়তো যেভাবে চলছে সেভাবে রেখে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে করোনার ওমিক্রন ধরন ছড়িয়ে পড়ায় কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ৫০তম সভায় কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। রাজনৈতিক সমাবেশ, ওয়াজ মাহফিল এবং বিয়ের অনুষ্ঠান ও মেলাসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধের সুপারিশ করেছে। ওমিক্রন থেকে সুরক্ষায় সরকার এরই মধ্যে যেসব বিধিনিষেধের ঘোষণা দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকার আওতায় আনতে বলেছে পরামর্শক কমিটি।
এছাড়া দেশে ঢোকার প্রতিটি জায়গায় স্ক্রিনিং, কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন আরও জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে। সংক্রমণ বেড়ে গেলে তা মোকাবিলায় হাসপাতালে পর্যাপ্ত সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রাখারও পরামর্শ দিয়েছে কমিটি।
গত সাত দিনে ছয় হাজার ৩০০ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা গত সপ্তাহের থেকে তিন হাজার ৩৭৬ জন বেশি। শতকরা হিসাবে গত সপ্তাহের তুলনায় ১১৫ শতাংশের বেশি রোগী এ সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছে। গত সাত দিনে করোনায় ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত সপ্তাহের থেকে ১৫ শতাংশ বেশি।