কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি আইভী

Slider রাজনীতি


চিটাগং রোড বাসস্ট্যান্ড থেকে দক্ষিণে মোড় নিলেই সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা শুরু। ব্যানার-ফেস্টুনে ঢাকা রাস্তার দুপাশ। সেখানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পোস্টার যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আরেক হেভিওয়েট স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের পোস্টারও। ব্যানার-পোস্টার ছাপিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে চাষাঢ়া রোডে চোখে পড়বে নানা উন্নয়নযজ্ঞ। দ্বিগুণ হচ্ছে রাস্তার আয়তন, নয়নাভিরাম হচ্ছে রাস্তার পাশঘেঁষে থাকা লেকও। তবে চলতি পথে পড়তে হতে পারে ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখেও। ব্যাটারিচালিত রিকশা আর ইজিবাইকের রাজত্ব রাস্তাজুড়ে, ক্ষণে ক্ষণেই ঘটছে দুর্ঘটনা। এবারের নির্বাচন অন্যবারের তুলনায় কিছুটা হলেও আলাদা আওয়াজ তৈরি হয়েছে। একমুখী নয়, লড়াইটা হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ডা. আইভী ও বিএনপি থেকে পদ হারানো হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের মধ্যে।

ভোটাররা বলছেন, ব্যক্তি আইভী নারায়ণগঞ্জে জনপ্রিয়। তবে এক আইভীর বিরুদ্ধে অন্য শক্তিগুলো একজোট হয়ে লড়াই করলে ভিন্নও হতে পারে পরিস্থিতি। কারণ জামায়াত, হেফাজত, জাতীয় পার্টি ও বাম ঘরানার লোকদেরও নিজের পক্ষে প্রচারে নামিয়েছেন তৈমূর। পাশাপাশি বিএনপি থেকে তৈমূর আলম খন্দকার অব্যাহতি পেলেও প্রচারে পাচ্ছেন দলটির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরই। এর বাইরে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে বহু বছর ধরে চলে আসা সেলিনা হায়াৎ আইভী-শামীম ওসমান দ্বৈরথ তো রয়েছেই। সবকিছু ছাপিয়ে কে পরবেন জয়ের মালা- সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। শহরের প্রসিদ্ধ রাজনীতিক আলী আহমেদ চুনকার মেয়ে আইভী এর আগে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়রও। বিএনপি সরকারের আমলের সেই নির্বাচনে বিপুল ভোটে হারিয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থীকেই। পৌরসভার মেয়র হওয়ার মধ্যে দিয়ে শক্ত রাজনৈতিক ভিত তৈরি করেন। এর পর ২০১১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সিটি মেয়র হন তিনি। ওই নির্বাচনে আইভী পান ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শামীম ওসমান পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট। এর পর ২০১৬ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে আইভী পান ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন পান ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। এ নির্বাচনে শামীম ওসমান দলীয় প্রার্থী আইভীকে সমর্থন দেন।

নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নাসিকে দুবার মেয়র হলেও আইভীকে একবারও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয়নি। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। কারণ শহরজুড়ে বেশ উন্নয়নকাজ হলেও আইভীর সমানতালে দ্বৈরথ বেড়েছে আওয়ামী লীগেরই অন্য একটি গ্রুপের সঙ্গে। এ গ্রুপে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান। আওয়ামী লীগের মহানগর ও জেলা কমিটির বেশিরভাগ নেতাকর্মীই তার সঙ্গে। যদিও আইভী ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণে এর আগেও এসব বিরোধিতা ও দ্বৈরথকে চ্যালেঞ্জ করেই উতরে গেছেন নির্বাচনী মাঠে।

স্থানীয়রা জানান, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ওসমান পরিবারের ত্যাগ প্রশ্নাতীত। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ ওসমান পরিবারের সদস্য শামীম ওসমান। ২০১১ সালে নাসিকের প্রথম নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে প্রার্থী ছিলেন তিনি। কিন্তু পরাজিত হন তৎকালীন স্বতন্ত্র প্রার্থী আইভীর কাছে। এর পরের নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেয়ে জয়লাভ করেন আইভী। এবারের নির্বাচনেও মনোনয়নের দৌড়ে শেষ হাসি হেসেছেন তিনিই। যদিও নাসিকের প্রতিটি ওয়ার্ডেই নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছে শামীম ওসমানের। এখনো তারা সিদ্ধান্তহীন- আইভীর নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করবেন, নাকি নিষ্ক্রিয় থাকবেন। শামীম ওসমানের ভাই একেএম সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির মনোনয়নে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ।

শামীম ওসমানপন্থি অনেকেই বলছেন নিজেদের ক্ষোভের কথাও। নাসিকের বর্তমান একজন কাউন্সিলর বলেন, করপোরেশনে উন্নয়ন কাজ হয়েছে। কিন্তু শামীম ওসমান বলয়ের কোনো কাউন্সিলর উন্নয়নকাজের ছিটেফোঁটাও বরাদ্দ পায়নি। বিশেষ এক সিন্ডিকেট সব কাজ করেছে। বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী বলছেন, তারা নিজেদের নির্বাচন নিয়ে কাজ করছেন। আইভী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নিধিরাম সর্দার হিসেবে ছিলেন। তাই এখন জনগণের কাছে নানা জবাবদিহি করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভোটে নিজে পাস করতে পারলেই খুশি। তারা বলছেন, করপোরেশনের ঠিকাদারি উন্নয়ন কাজেও নিজস্ব বলয় তৈরি হয়েছে। যারা কখনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, এমন ঠিকাদাররাই করপোরেশনের সব ঠিকাদারি কাজ করছেন।

নারায়ণগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক উন্নয়ন কাজ হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি। নাগরিকরা বলছেন, রাস্তায় রাস্তায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। অনেক স্থানে নাক চেপেও হাঁটা দায়। এর বাইরে শহরে পর্যাপ্তসংখ্যক পাবলিক টয়লেট নেই। বাসস্ট্যান্ড, ঘাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও পাবলিক টয়লেট না থাকায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে নারীদের।

তবে এবার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকার পাশাপাশি আইভীর রয়েছে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক তৈমূর আলম খন্দকার। যদিও নাসিক নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলের উভয় পদ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে তৈমূরকে। স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক পরিবারের পাশাপাশি ব্যক্তি পরিচিতিও ভালো রয়েছে প্রবীণ এ রাজনীতিকের। তার ভাই মাসুদুল আলম খন্দকার নাসিকের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। পাশাপাশি ছিলেন মহানগর যুবদলের আহ্বায়কের দায়িত্বেও। ফলে পুরো মহানগরের সব ওয়ার্ডেই আলাদা লোকবল রয়েছে তৈমূর আলম খন্দকারের। যেটি এর আগের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনের ছিল না। এর আগে ২০১১ সালে প্রার্থী হওয়ার পরও দলের অনুরোধে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়ান তৈমূর।

তৈমূর আলম খন্দকারকে বিএনপির পদ থেকে প্রত্যাহার করলেও তার প্রচারে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই রয়েছেন সর্বাগ্রে। পাশাপাশি তিনি পাশে পাচ্ছেন হেফাজত, জাতীয় পার্টি ও বিভিন্ন বামধারার সংগঠকদেরও। গতকালও তৈমূর আলম খন্দকারের গণসংযোগে দেখা গেছে এমনই চিত্র। বন্দরের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের সামনে থেকে এ গণসংযোগ শুরু হয়। গণসংযোগে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক এসএম আকরাম, বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আতাউর রহমান মুকুল, কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির দেলোয়ার হোসেন, বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির এহসান উদ্দিন আহমেদ, মুছাপুর ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির মাকসুদ হোসেন, স্বতন্ত্র নির্বাচনে জয়ী ধামগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন। আরও ছিলেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী নজরুল ইসলাম টিটু, বন্দর থানা বিএনপির সভাপতি নুর উদ্দিন, সদর থানা ছাত্রদলের সভাপতি কাজী নাহিসুল ইসলাম সাদ্দামসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী গণমাধ্যমকে বলেন, জনগণকে দেওয়া কথার বেশির ভাগই রেখেছি। সিটি করপোরেশন হওয়ার আগে নারায়ণগঞ্জে রাস্তা ও ড্রেন ছিল না। সাধারণ মানুষের এই চাহিদাটাই সবচেয়ে বেশি ছিল। মেয়র হওয়ার পরে আমি রাস্তা ও ড্রেন করে দিয়েছি। এখন যে চাহিদা- খাল খনন, খেলার মাঠ ও পার্ক। এগুলো নিয়ে আমি এখন কাজ করছি। আইভী বলেন, নগরীর অনেক ওয়ার্ডে সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই, মানুষ টিউবওয়েলের পানি খায়। নারায়ণগঞ্জের মানুষের দাবি এখন ওয়াসা। আমার প্রতিশ্রুতি হলো- আগের চলমান কাজগুলো আগে সম্পন্ন করা।

তৈমূর আলম খন্দকার সার্বিক বিষয়ে বলেন, আজকে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে- বিএনপির ভোট নৌকা মার্কায় যাবে না বরং অন্য মার্কার ভোট আমার কাছে আসবে। এখানে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ সব আছে। তারা যা করেছে বুঝেশুনে করেছে। স্থানীয় নেতাদের সাথে আমার সম্পর্ক; পানি কাটলে দুই টুকরো হবে, কিন্তু তৈমূর আলম খন্দকারের সাথে বিএনপির সম্পর্ক দুই টুকরো হবে না। তিনি আরও বলেন, এই নির্বাচনটা হলো জনগণের সঙ্গে ১৮ বছরের ব্যর্থতার লড়াই। এই নির্বাচনটা জনগণই করবে। বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে শ্রমিক, দিনমজুর খেটেখাওয়া মানুষজন যারা আছেন তারাই এই নির্বাচন করছেন।

আইভী-তৈমূর ছাড়াও অন্য মেয়র পদপ্রার্থী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাসুম বিল্লাহ্ (হাতপাখা), বাংলাদশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস (হাতঘড়ি), খেলাফত মজলিসের এবিএম সিরাজুল মামুন (দেয়ালঘড়ি), বাংলাদশ খেলাফত আন্দোলনের জসীমউদ্দীন (বটগাছ) প্রতিদিনই প্রচারে নামছেন। গতকাল নারায়ণগঞ্জ শহীদ মিনারের সামনে সমাবেশ করেছে ইসলামী আন্দোলন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল ইসলাম (ঘোড়া) এখনো প্রচারে নামেননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *