আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


১৬ ডিসেম্বর ২০২১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের ৫০ বছর। কোভিড মহামারীর এ দুঃসময়ে আমরা আজকের দিনে যারা উপস্থিত আছি, সত্যিকার অর্থেই ভাগ্যবান। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে নিশ্চয়ই আজ আনন্দের অশ্রু ঝরছে। ১৯৭১ সালে তাদের নয় মাসের যে সংগ্রাম ছিল তা বৃথা যায়নি। তারা তাদের সংগ্রাম ও তাদের যুদ্ধের ময়দানের সতীর্থদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশ পেয়েছিলেন- সে দেশের ৫০ বছরের বিজয় দিবসে উপস্থিত থাকতে পারছেন- এ তো তাদের বিরাট সৌভাগ্য। এ উপস্থিতি শুধু আনন্দের নয়, গৌরবেরও। দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, যেসব মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের প্রতি জানাই শোক ও শ্রদ্ধা।

আজ বাংলাদেশের অর্জনের দিকে তাকালে দেখতে পাই- করোনা মহামারীর মধ্যে বিদায়ী অর্থবছরেও জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, স্থির মূল্যে এই জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। আমাদের মাথাপিছু আয় এখন ২২২৭ মার্কিন ডলার। দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন বেড়েছে। গত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৩১.৫ থেকে ২০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে বৈদিশিক মুদ্রার রির্জাভ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।

৫৬,০০০ বর্গমাইলের বাংলাদেশ আজ অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই তৈরি করতে পারে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দক্ষতার জন্য চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানেরও ইতোমধ্যে প্রশংসা পেয়েছে। পুরো বাংলাদেশ হচ্ছে আজ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় আবৃত। বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে পায়রা নদীর ওপর ১.৫ কিমি দীর্ঘ ৪ লেনের পায়রা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে আজ বাংলাদেশিদের দেশের বাইরে গিয়ে দেখতে হয় না, আজ এসব যোগাযোগ ব্যবস্থা তার নিজ দেশেই আছে।

বিদ্যুতের জন্য কান্নাকাটি একসময় বোধহয় সব বাংলাদেশিই করত। আর আজ দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৬টি। বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। বিদ্যুতে আজ আলোকিত হচ্ছে শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত শরীয়তপুরের নড়িয়ার পাথার দুর্গম চর। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শহর থেকে গ্রামে আজ আর কেউ টিমটিমে আলোয় বসে নেই। বিদ্যুতের জন্য দিনের পর দিন আর প্রতীক্ষা নয় কারো। পরিবার- সমাজ সকল জায়গায় নিগৃহীত যে তৃতীয় লিঙ্গরা- তারাও এখন পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অহংকার, আর তাই মুক্তিযোদ্ধাদের এখন ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৩২ জন সাধারণ বীরমুক্তিযোদ্ধা মাসিক সম্মানী ভাতা পান।

দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষা। শিক্ষাকে কীভাবে আধুনিক-যুগোপযুগী করা যায় সে লক্ষ্যেই নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের প্রত্যেক জেলায় অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। দেশে এখন পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি রয়েছে। সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫-৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ১ বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছে। ১ জানুয়ারি মানেই হলো সারাদেশের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পূর্ণ সেট বই হাতে পাওয়া। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনা ও ধরে রাখার জন্য সারাদেশে শতভাগ উপবৃত্তি চালু আছে ও গ্রামাঞ্চলের নারীদের বিদ্যালয়মুখী করতে নারীবান্ধব শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। লিঙ্গ সমতা, নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে ।

তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি এখন দেখার মতো। বর্তমানে দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারীর সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এখন আইটি সেক্টরে প্রায় ১০ লাখ মানুষ কাজ করছেন। ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষতা অর্জন সাপেক্ষে কর্মস্থানের জন্য দেশে হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার জন্য বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছে। বলা যায়, দেশে এখন সব রোগের চিকিৎসাই করা সম্ভব ।

এত অর্জনের পরেও কেন আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি? দুঃখ হয়, যখন দেখি- আজ স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে যখন ক্রিকেট খেলা হয় তখন নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে সাপোর্ট না করে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে । তা হলে কি বলব-বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাসবিমুখ? তারা কি কেবল বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত, পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না তারা? তারা কি পরিবার/শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সম্পর্কে ধারণা পায়নি? অতীতকে বাদ দিয়ে কি তারা সঠিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারবে? তারা কি ১৯৭১-এর দুঃসহ সেই নয় মাসের কথা জানে না? ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকে তারা কীভাবে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করার স্পর্ধা দেখায়-তা বোধগম্য হয় না আমার। আজকের তরুণদের কি ‘বাংলার প্রতি ঘর ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে, আমাদের রক্তে টগবগ দুলছে মুক্তির দীপ্ত তারণ্যে’ এসব গান শরীরে কাঁপন ধরায় না? বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই কি তবে কোনো ‘বিশেষ ব্যাধিতে আক্রান্ত’?

দেশের এত অর্জন নষ্ট হয়ে যায়- কতিপয় দুর্নীতিবাজের দুর্নীতির কারণে। দুর্নীতি না হলে দেশ যে আরও কত এগিয়ে যেত তা বলাই বাহুল্য। দেশের এত অর্জন নষ্ট হয়ে যায়- যখন ধর্মের দোহাই দিয়ে কিছু মানুষ নানা অপকর্ম করেন। মানুষ মাত্রই তার মধ্যে সহনশীলতা, মানবিকতাবোধ থাকতে হবে। যারা দেশকে নানা অপকর্মের মাধ্যমে অস্থিতিশীল করে তারা কি সেই মুহূর্তে ভুলে যায় মানুষের সাধারণ গুণাবলির কথা?

দেশে আজ এত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্তু তারপরেও কেন শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে? পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও বিভিন্ন বিষয়ে আমরা কেন গুরুত্বপূর্র্ণ গবেষণা পাই না? দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পথে গবেষণার বিকল্প কী আছে ? প্রশ্ন আসে মনে, গবেষকেরা এখন গবেষণায় কেন ততটা আগ্রহী নন?

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো আগের মতো হচ্ছে কি? ঢাকার সিনেমা হলগুলো কয়জন চলচ্চিত্রপ্রেমীকে টানতে পারছে? থিয়েটারগুলোতে দর্শক সারি ফাঁকা কেন? শপিং সেন্টার, ফুডকোর্টগুলো মানুষে ভরপুর- বইয়ের দোকানে ভিড় আছে কি? একটা এলাকায় যত বিশ্ববিদ্যালয়ের, শপিং সেন্টারের, খাবার দোকানের দেখা মেলে তত বুক শপের, লাইব্রেরির,তরুণদের নানা বিষয়ে কথা বলার জায়গা আছে কি? এর ফলে কী হচ্ছে? সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায়, তরুণদের নিজেদের চাওয়া-পাওয়া ব্যক্ত করতে না পারার খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকে। জঙ্গিবাদ, মাদক, সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রগুলোতে পরিস্থিতির ক্রমাবনতি অহরহ ঘটছে।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের ৫০ বছরে আমাদের তো ‘কেবল উল্লাস করার কথা’। হতেই পারত সব কিছু মসৃণ! কিন্তু আজও কেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছি আমরা? দেশ তো আমাদের কম দেয়নি। দেশ আমাদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে-কিন্তু আমরা যারা তা নিচ্ছি, যাদের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হচ্ছে তারাই হয়তোবা দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারছি না। অনেক সময় ক্ষমতার অপব্যবহারও করছি। আমাদের নৈতিকতাবোধও পূর্বের চেয়ে অনেক কমে গেছে মনে হয়। আমরা মনে হয় আজকাল তোষামুদিতে বেশিরভাগ সময় আচ্ছন্ন থাকি। আমরা জ্ঞানসমৃদ্ধ, নৈতিক জীবনযাপনের চেয়ে একটা ভোগবাদী সমাজ নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলছি। এর ফল বোধহয় সুখকর হবে না। নিজেকে ভালো রাখতে হলে দেশকে কিন্তু সবার আগে ভালো রাখতে হবে। আর সে জন্য আমাদের খারাপ রিপুগুলোর লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। দেশকে ভালো রাখতে হলে প্রতিটি ব্যক্তিকে হতে হবে সচেতন এবং দেশপ্রেমিক। চলুন দেশকে ভালোবাসি। বিজয়ের ৫০ বছরের এই দিনেই দেশকে সত্যিকারের ভালোবাসার শপথ নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করি। সামনের দিনে দেশ নিয়ে কোনো দীর্ঘশ্বাস আমরা ফেলতে চাই না। আমরা সবাই এক সাথে বলতে চাই- ‘এই বাংলাদেশই তো আমরা চেয়েছিলাম’।

মৌলি আজাদ
মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *