দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ। তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থীদের বিপরীতে নির্বাচন করা দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে এবার আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না। দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে নির্বাচন করে জয়ী বা পরাজিত হওয়া কেউই পরবর্তীতে দলীয় কোনো আনুকূল্য পাবেন না বলে দফায় দফায় ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু বিদ্রোহীদের কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ যারা দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে প্রার্থী হচ্ছেন তাদের পেছনেও ঊর্ধ্বতন নেতাদের মদত রয়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারা মদত দিচ্ছে তাও খুঁজে বের করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বৈঠকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে পরীক্ষিত তিন নেতাকে দলের প্রেসিডিয়ামে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত আসে। দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, এই দুটি সিদ্ধান্ত দলের জন্য একটি বড় বার্তা।
ছাত্র রাজনীতি করে উঠে আসা জাহাঙ্গীর ক্রমে গাজীপুরে প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হন। তার এই উত্থানের পেছনে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও আর্শীবাদ ছিল। সবচেয়ে কম বয়সে দেশের বৃহৎ সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়া জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই ছিল দীর্ঘ দিনের। যেটি নানা সময়ে প্রকাশ্যে এসেছে। জাহাঙ্গীর আলম জেলার মন্ত্রী-এমপিদের খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না বলে অভিযোগ স্থানীয় নেতাকর্মীদের। কেন্দ্রীয় নেতাদের আর্শীবাদ থাকায় তিনি যেকোনো সমস্যায় পড়লে উতরে যেতে পারবেন বলে ধারণা করতেন। এ কারণে নিজস্ব বলয় তৈরি করে নিজস্ব স্টাইলে রাজনীতি পরিচালনা করতেন জাহাঙ্গীর। তাকে বহিষ্কারের মাধ্যমে দলীয় হাইকমান্ড এই বার্তা দিয়েছে যে, দলের চেয়ে কেউই বড় নয়। দলে কোনো ব্যক্তি অপরিহার্য নয়। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো কেন্দ্রীয় নেতার আশীর্বাদে অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
পোড় খাওয়া তিন নেতাকে দলের প্রেসিডিয়ামের সদস্য করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নেতাকর্মীদের আরেকটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। দলের দুঃসময়ে যারা হাল ধরে থাকেন তাদের আওয়ামী লীগ কখনোই ভুলে যায় না। তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম দলের দুঃসময়ে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের দলীয় প্রেসিডিয়ামে স্থান দেয়ার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়েছে। সামনে সারা দেশে দলের কমিটি গঠনের সময়ে একইভাবে ত্যাগী ও পোড় খাওয়া নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অভিযোগ আসার পর জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছিল। তিনি জবাব পাঠিয়েছিলেন। জবাবটি গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কারের আগে দুটি বিষয় সামনে আসে। বলা হয়, গাজীপুরে তিনি এখন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তার অনেক অনুসারী রয়েছে। তাকে বহিষ্কার করা হলে এতে দলে প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে দলীয় নেতাদের অন্য যুক্তি ছিল দলীয় প্রেরণার উৎস জাতির পিতাকে নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য দলীয় কারো মুখ থেকে আসতে পারে না। এমন কথা বলে পার পেয়ে গেলে ভবিষ্যতে আরও কেউ এমন স্পর্ধা দেখাতে পারে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলম এখনো গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্বে আছেন। দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর তিনি এ পদে থাকতে পারবেন কিনা এ নিয়ে আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে দলীয় প্রতীকে
নির্বাচন করে তিনি মেয়র হয়েছেন। তিনি এখন দলের কেউ না। তাই তার মেয়র পদে থাকার সুযোগ নেই। এ নিয়ে আইনি দিক বিবেচনায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারে। জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদ হারালে গাজীপুরে তার অবস্থান কী হয় সেটি এখন দেখার বিষয়।
সামনে জাহাঙ্গীর আলমের মতো আরও অনেকের পরিণতি হতে পারে। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী হওয়াদের বিষয়েও এমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দলীয় সূত্র জানায়, দলের বিরুদ্ধে যাওয়াদের বিষয়ে এবার আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না। কারণ দল ক্ষমতায় থাকায় অনেকে নানা সুবিধা নিয়ে নিজেদের অনেক ক্ষমতাশালী মনে করছেন। কোনো এলাকার সংসদ সদস্যরা দলীয় ফোরামের বাইরে নিজস্ব বলয় তৈরি করে তারা দলকে নিজেদের মতো করে চালানোর চেষ্টা করছেন। এতে জেলায় জেলায় আলাদা বলয় ও গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এই বলয় বা গ্রুপের এক পক্ষ আরেক পক্ষকে প্রতিপক্ষ মনে করছেন।
এ ছাড়া দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় অনেকে যে করেই হোক দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা, জেলা নেতা বা স্থানীয় এমপি’র আশীর্বাদে মনোনয়ন নিজের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে তফসিল ঘোষণার আগেই সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ঢাকায় এসে ভিড় করছেন। তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তদবির করছেন। এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে যাচ্ছেন মনোনয়ন পাওয়ার জন্য। দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক সাংগঠনিক সম্পাদক জানিয়েছেন, ইউনিয়ন পরিষদে দলীয় প্রার্থী ঠিক করতে তারা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছেন। প্রার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় নেতা, এমপিরা প্রার্থীদের পক্ষে তদবির করছেন। মাঠ পর্যায়ের রিপোর্ট ও দলীয় মূল্যায়নে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর বাদ পড়া অনেক প্রার্থীরাই আবার দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে নির্বাচনে নামছেন। এতে নির্বাচনে হানাহানি ও সংঘাতের ঘটনাও বেড়ে যাচ্ছে। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া হলে সামনে এমন ঘটনা আরও বেড়ে যাবে। তাই এ বিষয়ে দল কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
এর আগে ক্যাসিনো-কাণ্ডে ঢাকা মহানগর যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ অনেকের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। দায়িত্ব হারাতে হয় যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের। সে সময়ই দলে আসা হাইব্রিড ও সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠে। করোনা পরিস্থিতির কারণে পরে অবশ্য পুরো রাজনীতিই স্থবির হয়ে পড়ে। দলীয় নেতারা বলছেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে। এ অবস্থায় দল গুছানো ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া এখন দলের অন্যতম লক্ষ্য।
এমন অবস্থায় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ ঘনিয়ে আসায় কাউন্সিল নিয়েও আলোচনা রয়েছে। কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের আগে অনেক জেলা কমিটিতে কাউন্সিল করতে হবে। এসব জেলায় নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনেও দলীয় অবস্থান একই হবে বলে নেতারা মনে করছেন। বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরা যাতে জেলা কমিটিতে স্থান না পান সেদিকে নজর থাকবে কেন্দ্রীয় নেতাদের।