পেটের টানে কাটছে মায়া

Slider বাংলার মুখোমুখি

জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের পাহাড়ি দিঘলাকোনা গ্রামের ফাঁকা এই বাড়িটির ছবি সম্প্রতি তোলা – আমাদের সময়
‘সবাই এখন শহরে থাকে। কেউ কাজ-কাম করে; কেউ লেখাপড়া করে। আগে অনেক লোক ছিল। এখন পাহাড়ে কোনো কাজ-কাম নাই; নিরাপত্তাও নাই। দিনের বেলাও একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কেউ বুঝতেই পারবে না কি হচ্ছে এলাকার মধ্যে।
কথাগুলো বলছিলেন জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের পাহাড় দিঘলাকোনা গ্রামের জয় দাংগো। শুধু জয় দাংগো নয়। একই গ্রামের পাহাড়ি জনপদের আরেক বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী পুদি মারাক। সবুজ পাহাড়ের গা-ঘেঁষা বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ছোট একটি সংসার ছিল তার। সংসার এখনো আছে, তবে আকার আরও ছোট হয়ে এসেছে। পাহাড়ে কর্মসংস্থান না থাকায় জীবিকার তাগিদে তার স্ত্রী-সন্তানরা ঢাকায় কাজ করেন। শেষ জীবনে পাহাড়ের মায়া না ছাড়তে পারায় ছোট বাড়িতে এখন একাই থাকেন পুদি মারাক। বাড়ির কাজ ও বাগানের পরিচর্যা করেই সময় কাটে তার।

পুদি মারাক বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা সবাই বাইরে থাকে। কাজ-কাম করে। বছরে দু-একবার আসে। আবার চলে যায়। আমি এখন একা মানুষ। কোথায় যাব? পাহাড়ের মায়া ছাড়তে পারি না।’

বকশিগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, কামালপুর ইউনিয়নে এক সময় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য ছিল প্রায় দেড় হাজার। বর্তমানে এই সংখ্যা ৪শ-৫শ জনে দাঁড়িয়েছে।
এক সময় জুম চাষ ও কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করত এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা। এখন নানা বিধিনিষেধের পাশাপাশি জুম চাষের পরিধিও সঙ্কুুচিত হয়ে এসেছে। দেখা দিয়েছে কর্মসংস্থানের অভাব। ফলে জীবিকার তাগিদে পাহাড় ছেড়ে এখন শহরমুখী হচ্ছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কর্মক্ষম সদস্যরা।

পাহাড়ি এলাকা সাতানিপাড়ার বাসিন্দা নপু মারাক নপ্তরীও বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে পারছি না। কারণ জুম চাষ নেই। পাহাড়ে কাজ নেই। কেউ থাকে না।’

ছুটি কাটাতে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজেশ খোকশি বলেন, ‘আদিবাসিরা পাহাড়ে না থাকার কারণে বিশেষ করে যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটা হলো- পাহাড় ধ্বংস হচ্ছে। পাহাড় ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে আদিবাসিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতারা মনে করেন, সরকারের পক্ষ থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ গ্রামমুখী উন্নয়ন ও বনভূমি ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হলে পাহাড়িরা শহরে যাবে না। বিলুপ্তির হাত থেকে তাদের সংস্কৃতিও রক্ষা করা যাবে।

ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাংমা বলেন, ‘এখানে কোনো কর্মসংস্থান নেই। তাই আদিবাসিরা শহরমুখী হচ্ছেন। সরকার যদি আমাদের বন ব্যবহারের অনুমতি দেয়, তা হলে আমরা চিরস্থায়ীভাবে আবার আগের মতো বসবাস করতে পারব।’

বকশিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুন মুন জাহান লিজা বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যারা বকশিগঞ্জে আছেন, তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য উপজেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে একটি কালচারাল একাডেমিসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি দিয়েছে। এতে করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারবেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *