বাংলাদেশ প্রশ্নে ইইউর হুঁশিয়ারি

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

64575_f1

ঢাকা: গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বর্ণনা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ক্রমবর্ধমান সহিংসতার অবসান এবং রাজনৈতিক সঙ্কটের সুরাহার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার উপ-কমিটির সদস্যরা গতকাল এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান। বিবৃতিতে বলপূর্বক গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সুশীল সমাজের কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক  অধিকারের বিনিময়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যেসব বেসরকারি সংগঠন বিপন্ন মানুষের উন্নতির জন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে ফরেন ডোনেশন অ্যাক্টের আওতায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্বিঘ্নে বাস্তবায়নের জন্য এসব পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওদিকে, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোন উদ্বেগ নেই বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের দেয়া বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন প্রতিনিধিদলের প্রধান ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেডা। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের সামনে শাহরিয়ার আলমের বক্তব্য সংবলিত সংবাদের কপি দেখিয়ে বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণেই আমরা এ দেশ সফরে এসেছি। বৈঠকে গণগ্রেপ্তার নিয়েও প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়

 

বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে:  ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক তিন সদস্যের একটি সাব কমিটি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদশে সফর করেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য (এমইপি) ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেডা (দ্য ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি)। তার সঙ্গে ছিলেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য জোসেফ ওয়েডেনহোলজার (দ্য প্রেগ্রেসিভ এলায়েন্স অব সোশালিস্টস অ্যান্ড ডেমোক্রেটস), ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য ক্যারল কারস্কি (ইউরোপিয়ান কনজারভেটিভস অ্যান্ড রিফরমিস্টস গ্রুপ)। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। ২০০১ সালের কো-অপারেশন এগ্রিমেন্টের ধারা-১ অনুসারে এটা করা হয়। প্রতিনিধিদলের সফরের উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা নেয়া। শ্রম অধিকার, শিশু ও নারী অধিকার এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়ে ধারণা নেয়া। বিশেষ করে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থায় যে সহিংসতা সৃষ্টি তার পরিপ্রেক্ষিতে সুশীল সমাজের ও রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়ে প্রতিনিধিদের ছিল বিশেষ মনোযোগ। তারা সাক্ষাৎ করেছেন সরকার ও বিরোধী  দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। ক্রমবর্ধমান সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশের সুশীল সমাজ যে আহ্বান জানাচ্ছেন তারাও সেই আহ্বানের প্রতি সমর্থন জানান। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট অব্যাহতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রতিনিধিদল তা তুলে ধরেন। বহুজনের সঙ্গে তারা আলোচনা করেন। তাতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক  অধিকারের বিনিময়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে না। বহুদলীয় ও বলিষ্ঠ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। পার্লামেন্ট সদস্যরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন জোর দিয়ে। যেসব বেসরকারি সংগঠন বিপন্ন মানুষের উন্নতির জন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে ফরেন ডোনেশন অ্যাক্টের আওতায়। তারা এ প্রত্যাশা আবারও তুলে ধরেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্বিঘ্নে বাস্তবায়নের জন্য এসব পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রতিনিধিদল আরও সাক্ষাৎ করেছেন ট্রেড ইউনিয়ন, ব্যবসায়ী নেতা, পরিবেশ কর্মী, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সুশীল সমাজের সঙ্গে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে, রাজনৈতিক সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে। প্রতিনিধিদল ঢাকায় একটি তৈরী পোশাক কারখানা পরিদর্শন করেন। একর্ড গ্রুপের প্রতিনিধি, ট্রেড ইউনিয়ন ও শিল্পপতিদের সঙ্গে বিনিময় করেন। অনুসন্ধান ও পরামর্শ করে যেটুকু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তাকে স্বাগত জানিয়ে তারা একর্ডকে আরও সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে শ্রমিকরা যাতে দরকষাকষি করতে পারেন সে জন্য কার্যকর অধিকার নিশ্চিত করতে একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করার কথা বলেন। এর মাধ্যমে ইপিজেডসহ সব স্থানে যাতে সংশোধিত শ্রম আইন পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হয় তার ব্যবস্থায় সমর্থন দেয়ার কথা বলেন তারা। এছাড়া প্রতিনিধিদল মিরপুরে একটি স্কুল ও প্রকল্প পরিদর্শন করেন। শহরে পাড়ি জমানো শিশুদের নিয়ে গড়ে ওঠা এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন। তারা পরিচালনা করছে বেসরকারি সংগঠন ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’। শিশুদের মৌলিক শিক্ষায় অগ্রগতি অর্জনের ক্ষেত্রে সরকারের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন তারা। প্রতিনিধিদল আলোচনা করেন নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে। তারা সরকারের কাছে আহ্বান জানান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য। সরকার বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখবে বলেও তারা আশা প্রকাশ করেন। বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে তারা যেকোন অবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করার ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল অবস্থান তুলে ধরেন। প্রতিনিধিদলের প্রধান বলেছেন, আমরা বাংলাদেশে এসেছি। কারণ, এখানকার মানবাধিকার নিয়ে আমাদের মাঝে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আমরা বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে দেখতে চাই। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। তা বাস্তবায়ন করতে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র হবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ।
সহিংসতা ও সংলাপ একসঙ্গে চলতে পারে না: আওয়ামী লীগ
সহিংসতা ও সংলাপ এক সঙ্গে চলতে পারে না বলে সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানবাধিকার বিষয়ক সংসদীয় উপ-কমিটির প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ আরও জানিয়েছে, দেশে সহিংসতা চলছে, যারা এমনটা করছে তাদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না। এক সঙ্গে এই দুটি হয় না। গতকাল বিকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। তিনি বলেন, সহিংসতা, নাশকতা ও সংলাপ এক সঙ্গে চলতে পারে না। আগে নাশকতা, সহিংসতা বন্ধ হতে হবে। এসব বিষয়ে আমরা প্রতিনিধি দলকে অবহিত করেছি। গওহর রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আগেই বলেছেন- নির্বাচনের সময় যখন আসবে, তখন সবার সঙ্গেই কথা বলা যাবে, আলোচনা হবে। আমরা চাই দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু একটি নির্বাচন হোক। সে নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে। বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে ছিলেন দলের উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, এইচ টি ইমাম, এম জমির, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ফারুক খান, দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। বৈঠক শেষে ইইউ প্রতিনিধি দলের কেউ কথা বলেননি।
ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক : সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার বিষয়ক পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত সোয়া ১০টা পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত পিয়ারে মায়দুনের গুলশানের বাসায় এ বৈঠক অনুষ্টিত হয়। বৈঠক শেষে তিনি নৈশভোজেও অংশ নেন।
আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক: এদিকে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের সঙ্গেও বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধি দল। সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর আইনমন্ত্রী জানান, হরতাল-অবরোধে সারা দেশে যে পেট্রলবোমা হামলা হয়েছে এ বিষয়ে প্রতিনিধি দলকে অবহিত করা হয়েছে। মানবাধিকারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। মানবাধিকারের শিকড় যেন আরও শক্ত হয় সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। এ বিষয়টি প্রতিনিধি দলকে অবহিত করা হয়েছে।
স্পিকারের সঙ্গে বৈঠক: বাংলাদেশের চলমান সহিংসতা নিয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে জানতে চায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল। একই সঙ্গে এ নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কি না সে প্রশ্নও রাখেন তারা। স্পিকার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, সহিংসতা গণতন্ত্র বা রাজনীতির অংশ হতে পারে না। সহিংসতা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল গতকাল স্পিকার এবং সিপিএ নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক সাব-কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেদার নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরা হলেন সংসদ সদস্য জোসেফ ওয়েডেইনহোলজার ও ক্যারল কারস্কি। সাক্ষাৎকালে তারা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন। এ সময় তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সংসদ সচিবালয়ের গণসংযোগ শাখার পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, প্রতিনিধিদলটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের জনগণের সম্পর্ক বৃদ্ধিতে উভয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি বিনিময়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এদিকে সাক্ষাৎকালে স্পিকার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তৈরী পোশাকশিল্পকে আরও উন্নত করে এ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্পিকার আরও বলেন, তৈরী পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। এ সেক্টরে কর্মরতদের ৮০ শতাংশই নারী। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তাই সরকার তাদের সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদান, আবাসিক সুযোগ-সুবিধাসহ ডে কেয়ার সেন্টার, দুগ্ধ-মাতা (ল্যাক্টেটিং মাদার) ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায়সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। তিনি বলেন, নারী অধিকার মানবাধিকারেরই অংশ। সব নীতিমালা ও আইন নারী সংবেদনশীল করে তৈরি করে নারীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে বাংলাদেশ সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। সামাজিক ও স্বাস্থ্যসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুহার হ্রাস এবং বাল্যবিয়ে রোধে অগ্রগতি হয়েছে।
মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক: সকাল ১১টায় প্রতিনিধিদলের সদস্যরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যালয়ে যান। প্রতিনিধিদল দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি, শ্রমিক অধিকার, নারী ও শিশু অধিকার, সংখ্যালঘু অধিকার, চলমান সহিংসতা ও সন্ত্রাস এবং গ্রেপ্তার বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের করণীয় ও অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। সূচনা বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান প্রতিনিধিদলকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠনের পটভূমি ও কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কমিশন মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নে কাজ করে আসছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ গ্রহণ, তথ্যানুসন্ধান ও তা প্রতিকারের জন্য কমিশন রাষ্ট্রকে সুপারিশ করে আসছে। তিনি উল্লেখ করেন, মানবাধিকার কমিশন স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, তবে কমিশনের কোন নির্বাহী ক্ষমতা নেই। কমিশন মূলত একটি সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান। চলমান সহিংসতা প্রসঙ্গে ড. মিজানুর রহমান মন্তব্য করেন যে, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সহিংসতা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোন উপায় নয়। সহিংসতা শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য হুমকি স্বরূপ। মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাস ও সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। কমিশন সকল স্টেট ও নন-স্টেট ক্রীড়নকদের সহিংসতা ও সন্ত্রাস বন্ধের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করে আসছে। কমিশন মনে করে কোন ন্যায্য দাবি অর্জনের জন্যও সহিংসতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রতিনিধিদল সহিংসতা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান তুলে ধরে মন্তব্য করেন ‘সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়’। ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার বিষয়ে কমিশনের অবস্থান সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে জানানো হয়, কমিশনের অবস্থান সর্বদা বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে। কমিশন বিচারবর্হিভূত হত্যকাণ্ড বন্ধে নিয়মিত সুপারিশ করে আসছে। সম্প্রতি সংঘটিত বেশ কয়েকটি বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্বারা অনুসন্ধান করে কমিশনে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য আদেশ প্রদান করা হয়েছে। প্রতিনিধিদল সংবাদপত্রে প্রকাশিত আটকের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে কমিশনের বক্তব্য জানতে চাইলে কমিশন জানায়, বিদ্যমান আইনে সন্দেহজনক যেকোন ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পার। তবে সেক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত। কিন্তু আইনের ব্যতয় ঘটিয়ে যখন গণগ্রেপ্তারের মতো ঘটনা ঘটে তা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। নিরীহ নাগরিককে কিছুতেই গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা যাবে না। আটক বাণিজ্য চলতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে জনমনে আস্থার সঙ্কট তৈরি হবে। মতবিনিময়ে প্রতিনিধিদল এনজিওদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সরকারের যে উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য কাজী রিয়াজুল হক প্রতিনিধিদলকে দেশের শ্রমিক অধিকার পরিস্থিতি এবং কমিশনের করণীয় সম্পর্কে অবহিত করেন। কমিশনের অপর সদস্য মাহফুজা খানম প্রতিনিধিদলকে নারী অধিকার সুরক্ষায় কমিশনের কার্যক্রম ও উদ্যোগ সম্পর্কে অবহিত করেন। কমিশন সদস্য অ্যারমা দত্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিনিধিদলকে অবহিত করেন ও অপর সদস্য অ্যাডভোটক ফৌজিয়া করিম প্রতিনিধিদলকে জানান যে, শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কমিশন অনেক সময় আদালতে যাচ্ছে।
পররাষ্ট্র দপ্তরে দিনভর তৎপরতা: দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট (ইপি)’র মানবাধিকার বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্যরা স্পষ্ট ভাষায় উদ্বেগ জানিয়েছেন। বিরোধী রাজনীতিক, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিবর্গসহ ঢাকা সফরে যাদের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে সবখানেই প্রসঙ্গটি এসেছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট-সহিংসতা এবং এটি মোকাবিলায় সরকারের অ্যাকশন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তা কিভাবে বন্ধ করা যায়? সেই প্রশ্নও রেখেছেন তারা। পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই আয়োজনের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও ব্রাসেলস-এ নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহানসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সরকারের প্রতিনিধিরা সহিংসতার জন্য একতরফাভাবে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি তাদের দেখানো হয়েছে। ইপি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সরকারের বক্তব্য শুনেছেন, তারা তাদের উদ্বেগও জানিয়ে গেছেন। বৈঠক শেষে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধিরা কোন কথা না বললেও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। সেখানে তিনি বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখতে আসা প্রতিনিধিদলের সদস্যরা এখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ প্রকাশ করেননি বলে দাবি করেন। প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধিদলের প্রধানের গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা ছাড়াও কূটনৈতিক চ্যানেলে গতকালই বিষয়টি পররাষ্ট্র দপ্তরের নজরে আনা হয়। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ইইউর সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা বিষয়টি তাৎক্ষণিক প্রতিমন্ত্রীকে জানান। যদিও প্রতিমন্ত্রী সেই সময়ে সফররত ইতালীর উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে গণমাধ্যমে এটি ব্যাপকভাবে প্রচার পায়। বিকাল পর্যন্ত কর্মকর্তা পর্যায়ে এ নিয়ে দফা দফায় আলোচনার পর প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব, ইউরোপ উইংয়ের মাহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তরা। ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠক শেষে টেলিফোনে ইইউকে মিটিং, ব্রিফিং এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেন এক কর্মকর্তা। তাৎক্ষণিক এটাকে ডেমেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা হিসাবে আখ্যায়িত করে এক কর্মকর্তা বলেন, একটি টেলিভিশন চানেলের সাংবাদিকের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিমন্ত্রী ওই বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। সেখানে প্রশ্ন ও জবাব দুটিই অনেক বিস্তৃত ছিল। সরকারের তরফে ওই প্রশ্ন এবং জবাব দেয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা ছাড়াও পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। তবে ওই বৈঠক শেষে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ নিয়ে তার নতুন কিছু বলার আছে কি না জানতে চাওয়া হয়। গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোন ব্যাখ্যা দেয়া হবে কি-না? তাও জানতে চাওয়া হয়। জবাবে মন্ত্রী এ নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এদিকে রাত পৌনে ৮টার দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে একটি সংশোধনী গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। ‘জয়েন্ট কারেকটিভ স্টেটমেন্ট’ শিরোনামে পাঠানো সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা খালেদা বেগম প্রেরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, গণমাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রকাশিত কিছু রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা যৌথভাবে এটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র দপ্তরের এক ঘণ্টার মিটিংয়ে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি। শ্রম অধিকারের পাশাপাশি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেখানে চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যরা। এটা দেখাই ছিল তাদের সফরের উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *