লোকসান দেখিয়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


লোকসান দেখিয়ে আবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটি বলছে প্রতিনিয়ত তাদের লোকসান বাড়ছে। গত এক অর্থবছরেই লোকসান হয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া এ যাবৎ পঞ্জিভূত লোকসান রয়েছে আরও ৬২ হাজার কোটি টাকা। বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে আসছে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে তা ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করে থাকে পিডিবি। বিতরণ কোম্পানিগুলো সেই বিদ্যুৎ দেশের প্রায় সোয়া চার কোটি গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। তবে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভে থাকলেও ক্রয় ও বিক্রয়ের মধ্যে ফারাক থাকায় প্রতিবছর পিডিবি লোকসানে ডুবছে।

সর্বশেষ নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সংস্থাটি ৬২ হাজার ৪৬ দশমিক ২০ কোটি টাকার পুঞ্জিভূত ক্ষতির মুখে পড়েছে। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবি আরও প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। পিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন- লোকসানের অজুহাতে এভাবে দাম বাড়ানো উচিত নয়।

এ বিষয়ে ভোক্ত অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ¦ালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে এ পর্যন্ত আন্ত ১২ বার দাম বাড়িয়েছে পিডিবি। তবু লোকসান কমছে না। তিনি বলেন, লোকসানের অজুহাতে দাম বাড়ানো উচিত নয়। বরং বিদ্যুৎ খাতের ভুলনীতি ও দুর্নীতির কারণেই দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, এখনো ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেই বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বেজড লোড বা সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আনতে পারেনি। কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আনলেও সেটি গ্রিড সংকটে জাতীয় গ্রিডে দিতে পারছে না। তিনি বলেন, মূলত ভুল পরিকল্পনা ও দুর্নীতির কারণেই বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের ওপর দায় চাপানো হচ্ছে।

পিডিবি একক ক্রেতা হিসেবে ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি), রেন্টাল বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কেনে। এ ছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে সেই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে থাকে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) বেঁধে দেওয়া দামে পিডিবি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। একইভাবে বিতরণ কোম্পানিগুলোও বিইআরসির নির্ধারিত দামে গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে।

পিডিবির বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে যৌক্তিকভাবেই বিইআরসি বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় বা দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়; কিন্তু তার পরও কেন বছরের পর বছর পিডিবি লোকসান গুনছে জানতে চাইলে পিডিবির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, পিডিবির লোকসানের অন্যতম কারণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো থেকে পিডিবি বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করে। এ ছাড়া পিডিবির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনেক সিস্টেম লস আছে। নানা কারণে পিডিবি সেখানে সংশোধন করতে পারছে না। ওই কর্মকর্তা বলেন, পিডিবিকে সবচেয়ে বড় লোকসান গুনতে হয় জ¦ালানি সংকটের অনিশ্চয়তায়। গ্যাসভিত্তিক সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্যাসের সংকটে চালানো যাচ্ছে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে আরও অন্তত পাঁচ বছর আগে সরে আসার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। বরং তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়ছে। ফলে পিডিবি দিনের পর দিন লোকসান করছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, পিডিবিকে অটো বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ে যেতে হবে। বিশ^বাজারে জ¦ালানির সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রয়োজনে দাম বাড়বে, প্রয়োজনে কমবে। এ প্রক্রিয়ায় যেতে পারলে লোকসান কমে আসবে; কিন্তু সরকার নানা বিষয় বিশ্লেষণ করে সেদিকে যেতে পারছে না।

প্রাপ্ত তথ্যমতে পিডিবির ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) লোকসানের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। তারও আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লোকসান করে ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। প্রতিবছরই ঘাটতি মেটাতে সরকার ভর্তুকি দিয়ে আসছে।

অব্যাহত লোকসান বৃদ্ধির কারণ কী- এমন প্রশ্নে পিডিবির বর্তমান চেয়াম্যান প্রকৌশলী মো. বেলায়েত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক বেশি ওঠা-নামা করায় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া সাশ্রয়ী গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে পুরোপুরি চালানো যাচ্ছে না। ফলে তেলভিত্তিক ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ নিতে হচ্ছে গ্রিডে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রির মধ্যে অনেক তফাত থেকে যায়, যার ফলে পিডিবি অব্যাহত লোকসানের মধ্যে আছে।

এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, পিডিবির লোকসানের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সমন্বয় করতে না পারা। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা বা বিদ্যুৎ উৎপাদন সরবরাহ ব্যবস্থায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারা। ওই কর্মকর্তা বলেন, সরকার সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। অথচ গ্যাসের সংকটে সেগুলো পুরোপুরি চালানো যাচ্ছে না। আবার পায়রায় বড় বা বেজলোড কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। অথচ গ্রিড লাইন বা সঞ্চালন লাইনের সংকটে ১৩২০ মেগাওয়াটের সেই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সব সময় একটি ইউনিট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এমন অনেক অসঙ্গতি রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়। এগুলো দূর করা না গেলে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা পিডিবি সব সময় লোকসানের মধ্যেই থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *