ঢাকা: সময় ও ব্যয় কয়েক দফা বাড়ানোর পর অবশেষে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ‘পায়রা সেতু’। আজ রবিবার সকাল ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থানীয়দের বিশ^াস, ‘আধুনিক’ এই সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটনশিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে। সৃষ্টি হবে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।
বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের লেবুখালী নদীর ওপর নির্মিত এ সেতুটি চার লেনের। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর বলেন, এখন বরিশাল থেকে এক ঘণ্টায় পটুয়াখালী ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে যাওয়া যাবে। সময় কম লাগবে কুয়াকাটা যেতেও। বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যেতে এখন থেকে ফেরিও ব্যবহারও করতে হবে না। একই সঙ্গে পটুয়াখালী-কুয়াকাটার সঙ্গে বরিশালসহ সারাদেশের সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
সওজ সূত্র জানায়, এ সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭০ মিটার। এটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতুর আদলে নির্মিত। পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. আবদুল হালিম বলেন, এ সেতুতে ‘এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল সিস্টেম’ রয়েছে। ভূমিকম্প কিংবা বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ প্রযুক্তি তা জানিয়ে দেবে।
২০১২ সালের ৮ মে একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। ৪১৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ ও দরপত্রের কাজে দেরি হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু হয়নি। গত ৯ বছরে এ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকায়। কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে সেতুটি নির্মাণ হয়েছে। সেতুটি নির্মাণ করেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লংজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কনস্ট্রাকশন’।
পায়রা সেতু উদ্বোধনের পরই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লেবুখালী ফেরিঘাট। দীর্ঘ ৪০ বছরের এ ঘাটের কর্মচাঞ্চল্য হারালেও খুশি এখানকার বাসিন্দারা। লেবুখালী ফেরিঘাট সুপারভাইজার মো. আফজাল হোসেন জানান, এ ঘাটে চারটি নতুন এবং দুটি পুরনো ফেরি চলাচল করে। পটুয়াখালী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান জানান, সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা থেকে ফেরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পায়রা সেতুর টোল নিয়ে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সেতুতে ট্রেইলার ৯৪০ টাকা, ভারী ট্রাক ৭৫০ টাকা, মাঝারি ট্রাক ৩৭৫ টাকা, বড় বাস ৩৪০ টাকা, ছোট ট্রাক ২৮০ টাকা, কৃষিকাজে ব্যবহৃত যান ২২৫ টাকা, মিনিবাস-কোস্টার ১৯০ টাকা, মাইক্রোবাস ১৫০ টাকা, ফোর হুইল যানবাহন ১৫০ টাকা, সেডান কার ৯৫ টাকা, তিন-চার চাকার যান ৪০ টাকা, মোটরসাইকেল ২০ টাকা, রিকশা, ভ্যান, সাইকেল ও ঠেলাগাড়িকে ১০ টাকা হারে টোল দিতে হবে।
বরিশাল-পটুয়াখালী বাস মালিক সমিতির সভাপতি কাওছার হোসেন শিপন বলেন, ‘টোল পুনর্নির্ধারণ করা না হলে বরিশাল থেকে পটুয়াখালী রুটের পরিবহন ব্যবসা বন্ধের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ লোকসান দিয়ে কেউ গাড়ি চালাবে না।’
পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, পায়রা সেতু উন্মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক বিকাশের নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে তিন অথবা সাড়ে তিন ঘণ্টায় কুয়াকাটায় আসা যাবে। তখন অনেকেই সকালে রওনা হয়ে কুয়াকাটা এসে বিকালে আবার ঢাকায় ফিরে যেতে পারবেন। ফলে কক্সবাজারের চেয়ে কুয়াকাটা হবে তখন হটস্পট। এতে পর্যটন খাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। দেশের বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তারা তখন এ অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে আসবেন। পায়রা সমুদ্রবন্দর পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে এখান থেকে সড়কপথে স্বল্প সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশে পণ্য আনা-নেওয়া সহজ হবে।’
পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলমগীর জানান, ‘দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের একটি স্বপ্ন পূরণ করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন হয়, এটা বারবার প্রমাণিত।’
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন জানান, এ সেতু চালুর ফলে পায়রা বন্দর, পর্যটন নগরী কুয়াকাটা, নির্মাণাধীন পটুয়াখালী ইপিজেডসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনমান পাল্টে যাবে। কৃষি এবং মৎস্যশিল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। কুয়াকাটা পর্যটননগরী হবে ঢাকার সবচেয়ে কাছের সমুদ্রসৈকত।
বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম বাদল মনে করেন, ‘পায়রা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগে নতুন যুগের সূচনা হলো।’