দইবড়া আপু মাকসুদা কাননের উদ্যোক্তা জীবনের অজানা গল্প

ঃ স্বপ্ন পূরণ উদ্যোক্তাদের গল্প অনুষ্ঠানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
আসসালামু আলাইকুম আপু,কেমন আছেন?

ঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?
ঃজ্বি আপু ভালো আছি।আপু প্রথমে আপনার পরিচয়টা দিন-

ঃ আমি মাকসুদা মোসাব্বির কানন, সাউথ পয়েন্ট স্কুল, মালিবাগ শাখায় ইংলিশ মিডিয়াম এর সিনিয়র ইংলিশ টিচার হিসেবে শিক্ষকতা করছি ২০১১ সাল থেকে।

শিক্ষকতার পাশাপাশি সবার দোয়ায় এবং সহযোগিতা নিয়ে বর্তমানে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে মোটামুটি একটা পরিচিতি অর্জন করেছি, আলহামদুলিল্লাহ!

ঃআপনার শৈশব কেটেছে কোথায়? আপনার শিক্ষা জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।

ঃআমার দাদা বাড়ি এবং নানাবাড়ি সিলেটে হলেও আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকার খিলগাঁও এলাকায়। কারণ আমার বাবা চাকরি সুবাদে ঢাকায় থাকা শুরু করেছিলেন ১৯৬৯ সাল থেকে।সেই সুবাদেই আমাদের ঢাকা খিলগাঁও এলাকায় বেড়ে ওঠা।

পড়াশোনার প্রাথমিক পর্যায় শুরু হয়েছিল রোকাইয়া কিন্ডারগার্টেন স্কুলে, তারপর মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়/সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ থেকে ইন্টার পাশ করেছি।তারপর অনার্স করি খিলগাঁও মডেল কলেজ থেকে ও মাস্টার্স করেছি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ থেকে।
এরপর ইংল্যান্ড থেকে TESOL (Teaching English to the Speakers of Other Languages) করেছি।

ঃ উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা আপনার মাথায় কেমন করে এলো?

ঃ উদ্যোক্তা হবার কোনরকম চিন্তাই কখনও মাথায় ছিল না আমার, বরং ব্যবসা সম্পর্কিত যেকোন বিষয়ই আমার কাছে ভীষণ জটিল এবং বুদ্ধিমত্তার কাজ বলে মনে হতো। শুধু তাই নয়, আমার মনে ব্যবসা সম্পর্কে বেশ নেতিবাচক ধারণাও ছিল।

ঃএই নেতিবাচক মনোভাব থেকে কেমন করে উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেন?

ঃ কিভাবে উদ্যোক্তা হয়ে উঠলাম সেই গল্পটাই এখন বলছি-
আমার স্কুলে সহকর্মীদের নিজস্ব উদ্যোগে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন উপলক্ষে খানাপিনার আয়োজন হতো, আমরা শিক্ষকরাই রান্না করে বিভিন্ন ধরনের আইটেম নিয়ে যেতাম স্কুলে, সবাই মিলে একসাথে খেতাম।তখন একটা উৎসব মূখর পরিবেশ বিরাজ করতো। সে সময় আমার উপর দায়িত্ব পড়তো দইবড়া করে নিয়ে যাওয়ার।
মজার ব্যাপার হলো, প্রথম দিকে সীমিতসংখ্যক শিক্ষকদের মাঝে ব্যাপারটা থাকলেও পরবর্তীতে সবার কাছেই খাবারটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে গেল। তখন প্রায়ই আবদার আসতে লাগলো,
“আপা, কবে আবার দইবড়া আনবেন?”
আমি তো মহা বিপদে পড়ে গেলাম, কারন নিলে সবার জন্যই নিতে হবে। তখন একজন শুভাকাঙ্খী আইডিয়া দিলেন,
“আপনি ছোট বক্সে করে নিয়ে আসবেন , আমরা সবাই কিনে নিবো!”
আমিও বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম কি করা যায়, কিন্তু এরইমধ্যে প্রকৃতির বৈরী পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘ মেয়াদী স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
প্রথম দিকে বাসায় বসে থেকে সময় ভালো কাটতো না, তাই গ্রুপ মেসেঞ্জারে সবার কথপোকথন হতো,বিভিন্ন বিষয় আদান-প্রদান চলতো, কার বাসায় কি রান্না হলো এসব বিষয়ে আড্ডা হতো।
আমার আম্মুর খুব পছন্দের খাবার দইবড়া। তাই আমি প্রায়ই বানাতাম আর ছবি দিতাম ফেসবুকে ।
ফেসবুকে ছবি দেখে এবার সবাই আমাকে ছেঁকে ধরলেন, দইবড়া খাবেন। আমি তখনই বাজারে গিয়ে বক্স, ব্যাগ, স্কচটেপ কিনে আনলাম।
কিন্তু লকডাউনের মধ্যে পাঠাবো কি করে? ডেলিভারি ম্যান খুঁজতে হবে, কিন্তু বিশ্বস্ত লোক কোথায় পাবো?
এই সব বিষয় নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম।
আমার এক সহকর্মী ছোট বোন, যিনি আমার দইবড়ার সর্বাধিক বারের ক্রেতা, তিনি ডেলিভারি দেয়ার দায়িত্ব নিলেন প্রথম দিন।
দিনটি ছিল ২৮ জুন২০২০, আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন!

তখনও উদ্যোগ এর জন্য কোন পেইজ
খুলিনি যেহেতু একটামাত্র খাবার নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম।

কিছুদিন পর পেইজ খুললাম, “Tasty দইবড়া” নামে। কারন দইবড়াই আমার একমাত্র খাবার ছিল, যা দিয়ে আমার পরিচিতি তৈরি হয়েছে। বলা যায় দই বড়াই আমার সিগনেচার প্রডাক্ট।

এরপর টানা দুমাস শুধু দইবড়াই অনলাইনে অর্ডার নিয়ে বিক্রি চললো।
তারপর একে একে যোগ করলাম, বিভিন্ন ধরনের আচার, কেক, চকলেট, পায়েস, টুনা মাছের কাবাব ইত্যাদি।

ঃউদ্যোক্তা জীবনে কখনও কোনো বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন কি?

ঃউদ্যোক্তা জীবনে সবচেয়ে বড় বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি ডেলিভারি নিয়ে, কারন দইবড়া ফ্রোজেন ফুড, সাথে সাথে ডেলিভারি দিতে হয়।
এ কারনে চার্জ বেশী হয়ে যায়, অনেক সময় ক্রেতাও এতে মনক্ষুণ্ণ হয়ে যান, অথচ আমি নিরুপায়।
ডেলিভারি সমস্যাটাই বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।সেই বাঁধা অতিক্রম করেই সামনে এগিয়ে চলেছি।

ঃ উদ্যোক্তা জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা বলুন-

ঃ উদ্যোক্তা জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই-

আমার একজন নতুন ক্রেতা মেসেঞ্জার এ নক দিয়ে বললেন দইবড়া খাবেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনার ঠিকানা?”
সে উত্তর দিল মৌলভীবাজার।
তার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত, কারণ ঢাকার বাইরে এই ফ্রোজেন ফুড পাঠানো যাবে না। আমার কথা শুনে ক্রেতা বেচারি খুব মন খারাপ করলেন। কিন্তু কথা দিলেন, ঢাকায় এলে অবশ্যই আমার দইবড়া খাবেন।
আলহামদুলিল্লাহ, তিনি তার কথা রেখেছেন। চার মাস আগে ঢাকায় এসেই আমাকে বলেছেন, দইবড়া পাঠাতে, তার বোনের বাসায়।
আমার মতো একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য এটা একটা বিরাট পাওয়া।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া!
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, রাজশাহী থেকে ও অনেকে আমার দইবড়া খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

ঃউদ্যোক্তা জীবনে আপনি কতটা সফল হয়েছেন বলে আপনি মনে করেন?

ঃ আমার মনে হয়, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আমি আংশিক সফল, কেননা এখনও অনেক কিছু জানতে বাকী, শিখতে হবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে। তবে ইতিমধ্যেই বেশ খানিকটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ!

বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ আংশিক চালু হওয়াতে অনলাইন ক্লাস এবং অফলাইন ক্লাস দুই ই চলছে, তাই ব্যস্ততাও বেড়েছে হঠাৎ করে, উদ্যোগ চালিয়ে নিতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
কিন্তু তাই বলে থেমে যাবো, একথা কিন্তু ভাবছি না। উদ্যোগ চলবে যেভাবেই হোক।

ঃ উদ্যোগ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

ঃ উদ্যোগ নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সময়ই বলে দেবে। কারন পরিচিতি আরো বাড়াতে হবে, তখন আমার নিজস্ব একটা খাবার দোকান প্রতিষ্ঠা করা সহজতর হবে, ইনশাআল্লাহ!

ঃ আপনার উদ্যোগের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?

ঃ আমার উদ্যোগ এর পেছনে সমস্ত অবদান আমার প্রিয় সহকর্মী বড় এবং ছোট বোনদের । তাঁরাই সারাক্ষণ আমাকে দিকনির্দেশনা দিয়ে উৎসাহিত করে এগিয়ে যেতে সাহস যুগিয়েছেন এবং এখনও আমার পাশে আছেন, আলহামদুলিল্লাহ।

আরেকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন স্বপ্ন পূরণ গ্রুপের এডমিন আপু খায়রুননেসা রিমি।
রিমি আপুও আমার সহকর্মী। তিনিও আমাকে পরিচিতি বাড়াতে বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছেন।

ঃস্বপ্ন পূরণ গ্রুপ আপনার স্বপ্ন পূরণে কতটা ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন?

ঃ স্বপ্ন পূরণ গ্রুপ খুব এক্টিভ একটা গ্রুপ, এই গ্রুপের সদস্যরা সবাই খুব সহযোগী মনোভাবাপন্ন। মডারেটর আপুরাও ভীষণ দক্ষতা এবং সচেতনতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
আমি খুবই আশাবাদী,আমার স্বপ্ন পূরণ করতে এই গ্রুপ বিশেষ ভাবে অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি। ইনশাল্লাহ স্বপ্ন পূরণ গ্রুপের মাধ্যমেই আমার উদ্যোক্তা জীবনের সকল স্বপ্ন পূরণ হবে।
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই স্বপ্ন পূরণ গ্রুপের এডমিন খায়রুননেসা রিমি আপুর প্রতি।
আপু আমাকে বিভিন্ন ভাবে বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়ে আমাকে বিশেষ ভাবে গাইড করে আমাকে সফল উদ্যোক্তা বানানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন।
খায়রুননেসা রিমি আপুর মতো এমন দায়িত্বশীল গ্রুপ এডমিন থাকলে আমাদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সফল না হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। অাপু অলরেডি স্বপ্ন পূরণ গ্রুপে আমাকে
” দইবড়া আপু “নাম দিয়েছেন।এই গ্রুপে দইবড়া আপু মানেই হলো আমি মাকসুদা কানন।এটা আমার জন্য একটা বিরাট প্রাপ্তি।গ্রুপে আমি একদম নতুন তারপরেও গ্রুপ থেকে টুকটাক আমার অর্ডার আসতে শুরু করেছে।পরিচিতি বাড়লে সেলও বাড়বে ইনশাআল্লাহ। তাই আমি আপাতত পরিচিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছি।

ঃঅনেক ধন্যবাদ আপু,স্বপ্ন পূরণ উদ্যোক্তাদের গল্প অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আজ আপনার উদ্যোক্তা জীবনের অনেক গল্প জানলাম। দোয়া করি স্বপ্ন পূরণ গ্রুপের মাধ্যমে আপনার স্বপ্ন সফল হোক।শুভকামনা আপনার জন্য।

ঃআপনার জন্যও শুভকামনা আপু । আমার জন্য দোয়া করবেন ও আমার স্বপ্ন পূরণে সার্বিক সহযোগিতা করবেন।

ঃইনশাল্লাহ পাশে আছি সব সময়।স্বপ্ন পূরণ গ্রুপ সব সময় নতুন উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে কাজ করছে।ইনশাল্লাহ আপনার স্বপ্নও পূরণ হবে খুব শিগগির। শুভকামনা আপনার জন্য।

সাক্ষাৎকার গ্রহণে ঃ খায়রুননেসা রিমি