প্রশাসনে অভিযোগের স্তূপ হাতেগোনা শাস্তি

Slider জাতীয়


মাঠ প্রশাসনে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের করা অভিযোগ জমা হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। অভিযোগকারীদের দাবি, হাতেগোনা কিছু ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তদন্ত হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। এসব অভিযোগ তদন্তও করছেন নিজ ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তারাই। তদন্তের নামে নানা কৌশলে অভিযুক্ত জুনিয়র কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। আবার কিছু কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে লোক দেখানো ওএসডি করা হচ্ছে। এরপর বিভাগীয় মামলায় গুরুদণ্ডের মতো অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দেয়া হচ্ছে লঘুদণ্ড।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে প্রশাসনের দুই হাজার ৭৪৮ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারীঘটিত সমস্যাসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব অভিযোগ তদন্ত করে ৩৬৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক সত্যতা পায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিধিমালার আলোকে ৩৬৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। এর আগে সহ এ নিয়ে মোট ৪৪০টি বিভাগীয় মামলার মধ্যে গত ১০ বছরে ৬৭ জন কর্মকর্তাকে গুরুদণ্ড, ১২৬ কর্মকর্তাকে লঘুদণ্ড, ২০৩ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (উপ-সচিব) শাহীনুর আলম প্রাক্তন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (নীলফামারী) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে থাকাকালে জেলার ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের উত্তর খড়িবাড়ী মৌজায় তিস্তা নদীর উপর সৃজিত বালুমহালের ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে ইজারা গ্রহীতা কর্তৃক দাখিলকৃত চেক ব্যাংকে জমা না দিয়ে ইজারা বাবদ সমুদয় অর্থ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে ইজারা গ্রহীতার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩ (খ) বিধি অনুযায়ী যথাক্রমে অসদাচরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। ব্যক্তিগত শুনানি ও লিখিত বক্তব্য সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সিদ্ধান্ত নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

বিভাগীয় মামলায় অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পাননি তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রাদি পর্যালোচনা করে তাকে গুরুদণ্ড প্রদানের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে গুরুদণ্ড থেকে সরে এসে গত ১০ই আগস্ট সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৪ (২) (ঘ) বিধি অনুযায়ী তার এক বছরের জন্য বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমিতকরণ নামীয় লঘুদণ্ড প্রদান করা হয়। আলোচিত কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনকে ‘লঘুদণ্ড’ দিয়েছে সরকার। তার দুই বছরের বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছে। মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে অভিযুক্ত সুলতানা পারভীনকে এই শাস্তি দেয়া হয়। যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (শিক্ষানবিশ) নাদির হোসেন শামীমের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একাধিক নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। একাধিক নারীর অভিযোগ তদন্ত শেষে তা প্রমাণিত হলে শুধুমাত্র ‘তিরস্কার’ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রতারণার শিকার একজন নারী বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা শামীমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে মৌখিক বক্তব্য শোনেন। এরপর ওই বক্তব্য লিখিত আকারে গ্রহণ করেন। শামীমের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছবি এবং মেসেঞ্জারে দুজনের কথোপকথনের প্রিন্টকপিসহ বিভিন্ন আলামত সংযুক্ত করে দেই। শামীম অভিযোগকারী শিক্ষিকার সঙ্গে ‘প্রেম’ ও শারীরিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। তার পরও এমন লঘুদণ্ডে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। এর পরেও ঐ কর্মকর্তা বর্তমানে তার দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সরিয়ে নিতে খুলনার বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান। বিভাগীয় কমিশনার খুলনাকে দেয়া চিঠিতে তিনি বলেন, নাদির হোসেন শামীম (১৮৪৩৬), সহকারী কমিশনার (শিক্ষানবিশ), জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, যশোরে কর্মরত আছেন। এর পূর্বে তিনি আরও দুইটি জেলায় কর্মরত ছিলেন। একাধিক নারী অভিযোগ করায় শিক্ষানবিশ এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু হয় এবং তিনি ‘তিরস্কার’ সূচক লঘুদণ্ডে দণ্ডিত হন। বর্তমানে এ জেলায় কর্মকালে তিনি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হচ্ছেন। এজন্য তাকে অন্যত্র বদল করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় তাকে অন্যত্র বদলি করার অনুরোধ করা হয়।

নাটোরের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানী দীঘির দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দেয়ার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের জন্য উপ-সচিব (ওএসডি) নাজমুন নাহার মান্নুর দুই বছর বেতন বাড়বে না। ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮’ অনুযায়ী নাজমুন নাহারকে লঘুদণ্ড দিয়ে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। নাজমুন নাহার মান্নু ২০০৪ সালের ৩রা এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ৫ই জুন পর্যন্ত নাটোরের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে কর্মরত থাকাকালে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাছ চাষের জন্য নাটোর আধুনিক মৎস্য চাষ প্রকল্প লিমিটেডের অনুকূলে ১০ বছরের জন্য বন্দোবস্তকৃত নাটোর সদর উপজেলাধীন ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ৬০০৪, ৬৯৪৩ ও ৮৫১৭ নং দাগে অবস্থিত ২৭ দশমিক ১৬৯৬ একর আয়তনবিশিষ্ট অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানী দীঘির দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রস্তাব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই বিধিবহির্ভূতভাবে অগ্রগায়ন করায় এবং পরবর্তীকালে জেলা প্রশাসক তা অনুমোদন দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ এর বিধি ৩ (খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগ এনে বিভাগীয় মামলা করা হয়।
আপনার মতামত দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *