খুলবে না হাজারো স্কুলের দরজা

Slider সারাদেশ


সান সাইন কিন্ডারগার্টেন। ৪ বন্ধু মিলে চালু করেছিলেন স্কুলটি। ২০১৮ সালে শুরু হয় স্কুলটি। চলছিলও বেশ। শিক্ষক ছিলেন ৮ জন। সবসহ স্কুলে কাজ করেন ১৩ জন। নিজেদের বেকারত্ব ঘোচাতে স্কুলটি হয়ে ওঠে একটা মাধ্যম। স্কুলে সাইনবোর্ড থাকলেও বর্তমানে স্কুলটি রিকশাভ্যান রাখার গ্যারেজ ও রুমগুলোতে রাখা হয় সুপারি।

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার শঠিবাড়ীতে এই স্কুলটি। স্কুলের দু’জন শিক্ষক এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। যোগ দিয়েছেন কৃষি কাজে। আর আরেকজন শিক্ষক যোগ দিয়েছেন সেলসম্যানের কাজে। করোনার আগে স্কুলে ৭৮ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত ছিল। কিন্তু দীর্ঘ বন্ধে আর কুলিয়ে উঠতে পারেননি তারা।

রাজধানীর আদাবর ৯ নম্বর এলাকার একটি স্কুলেও একই চিত্র দেখা যায়। উপরে বড় করে লেখা মর্নিং গ্লোরি চাইল্ড গার্ডেন স্কুল। ৩ রুমের স্কুলে ভাড়া দেয়া হয়েছে কর্মজীবী লোকদের মেস হিসেবে। করোনার আগে এই স্কুলে শিক্ষার্থী ছিল ৬২ জন।

রংপুরের স্কুলটির প্রধান শিক্ষক রেজাওয়ানুল ইসলাম বলেন, স্কুলটির ভাড়া দিয়ে হয় সাড়ে ৮ হাজার টাকা। শুরুর দিকে শিক্ষার্থীরা বেতন দিতো আমরাও শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার খবর রাখতাম। কিন্তু দীর্ঘ এই বন্ধে আর মেইনটেইন করা সম্ভব হয়নি। স্কুলটাকে বাঁচিয়ে রাখতে ৬ হাজার টাকায় ভাড়া দেই। প্রতিমাসে আড়াই হাজার টাকা পকেট থেকে দিতে হয়। তিনি আরও বলেন, আমি চাই স্কুল খুলতে, কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে সরকার চাইলেও আমরা স্কুল খুলতে পারবো না। আমাদের অবকাঠামো ভেঙে গেছে। শিক্ষক নেই, প্রয়োজনীয় লোকবল, সামগ্রী এমনকি শুরুর প্রস্তুতি নেবার মতো অর্থও নেই। আর সব থেকে বড় কথা আমাদের এখন স্কুল খুললেও শিক্ষার্থী আসবে না। কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলো, তারা জানালেন এ বছরে আর স্কুলে পাঠাবেন না। সম্ভব হলে ২০২২ সাল থেকে ফের স্কুল শুরু করবো।

রাজধানীর আদাবরের স্কুলটির উদ্যোক্তা ও শিক্ষক ঝুমুর রহমান বলেন, আমাদের মূলত প্রি-প্রাইমারি থেকে শুরু করে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়াই। কিন্তু এই সময়ে এসে শিক্ষকদের নতুন করে নিয়ে আসা বা শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করা সম্ভব নয়। আর এই মুহূর্তে স্কুলের কোনো অবকাঠামোই ঠিক নেই। তিনিও ২০২২ সাল থেকে স্কুল চালু করার কথা বলেন।

এই দুই স্কুলের মতো দেশব্যাপী হাজারো স্কুলে ১২ই সেপ্টেম্বর রোববার খুলবে না তালা। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের তথ্য মতে, দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এর মধ্যে ৪০ হাজার স্কুল তাদের কার্যক্রম সীমিত করে নিয়েছে। ১০ হাজারের মতো স্কুল হারিয়ে গেছে।

দেশজুড়ে ৯ জেলার ১০০’র কম শিক্ষার্থী ছিল এমন ১২টি স্কুলের খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩টি স্কুল স্বল্প পরিসরে খুলতে যাচ্ছে বাকি স্কুলগুলোর মধ্যে ৩টি খুলবে না। আর বাকি ৫টি স্কুল সামনের বছরে খোলার পরিকল্পনা করছে।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার স্কুল শিক্ষক মিমি জাহান বলেন, আমি এই স্কুলের শিক্ষক ও একাংশের মালিক। এই স্কুলে আমার ৮০/৮৫ জনের মতো শিক্ষার্থী ছিল। অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। তারা এই করোনার সময়ে বেতন দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। আমরাও বেতন নেয়ার মতো কোনো যৌক্তিক যুক্তি পাইনি। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী সরকারি স্কুলে শিফট হয়েছে। অনেকে হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে আছে।

কথা হয় রাজবাড়ীর এক অভিভাবক সাগর মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাচ্চারা বাড়িতে বসে পড়ছে। পড়াচ্ছে তাদের মা। স্কুলে যায় না। বেতন দিয়ে কী হবে? তাই দেইনি। এখন স্কুল খুলছে। ভাঙা বছরে আর কিন্ডারগার্টেনে পাঠাবো না। আমার গ্রামের বাড়ির প্রাইমারিতে ভর্তি আছে ওখানেই এ বছর পড়ুক। সামনের বছর দেখি কী করা যায়।

সাগর মোল্লার দুই সন্তান। বড় মেয়ে চতুর্থ ও ছোট ছেলে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। করোনায় স্কুল বন্ধ হওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন সন্তান, স্ত্রীকে। ছেড়ে দিয়েছেন ভাড়া বাড়ি। সামনের বছরে ফের বাড়ি ভাড়া নেয়ার পরিকল্পনা করছেন বেসরকারি একটি সিম কোম্পানির এই চাকরিজীবী।
স্কুল খুললেও অনেকেই এসব কিন্ডারগার্টেনে আর পড়ার সুযোগও হয়তো পাবে না। এসব স্কুলে অধিকাংশই লেখাপড়া করে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষার্থীরা। তাদের আয়ে একটা ভাটা পড়ায় তারাও ঝুঁকছেন সরকারি স্কুলগুলোতে। তবে জেলা শহরের স্কুল বিশেষ করে পঞ্চম শ্রেণির ওপরে যেসব স্কুলে পড়ানো হয় তাদের শিক্ষার্থীদের ফিরে আসা নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই। তবে কমে যাওয়ার শঙ্কা আছে।

রংপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল ফুয়াদ আহমেদ। এখন সে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ভর্তি হয়েছে শঠিবাড়ি বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ফুয়াদ বলে, করোনায় আব্বার ব্যবসায় লস হইচে। এরপর রংপুরের বাসা ছেড়ে দিয়ে এলাকায় চলে আসছি। ব্যবসাটা ভালো হচ্ছে দিন কে দিন। আর রংপুরে পড়বো না। এই স্কুল থেকেই এসএসসি পাস করে শহরে যাবো।

বেসরকারি এসব স্কুলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দীর্ঘ ১৭ মাস বেতন ছাড়া বা স্বল্প বেতনে কাজ করে গেছেন। অনেকেই বদলে ফেলেছেন পেশা। অনেকে আর ফিরবেন না শিক্ষকতায়। আর স্কুলও খুলবে না অনেক।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, আমাদের ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। আমরা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। বন্ধের সময় আমরা সরকারি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাইনি। এই মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর সহযোগিতা না পেলে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হারিয়ে যাবে। তিনি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচাতে সুদমুক্ত ঋণের দাবিও জানান। এই মুহূর্তে অনেকেই স্কুল খুলবে না। খুললেও শিক্ষার্থী পাবেন না। নভেম্বর থেকে নতুন ভর্তি শুরু হয়। এই সময়ে যদি স্কুলগুলো দাঁড়াতে না পারে নতুন শিক্ষার্থীদেরও আনতে পারবে না। ঋণে জর্জরিত এসব স্কুলগুলোকে টিকে থাকতে চাই অর্থ, সহযোগিতা। আর না পেলে স্কুল হারিয়ে যাবার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *