সিলেটে এক ব্যতিক্রমী নির্বাচন চলছে। একদিকে চলছে লকডাউন। অন্যদিকে শেষ মুহূর্তে জমে উঠেছে প্রচারণা। স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই। প্রার্থী ও ভোটাররা মিলেমিশে একাকার। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় পরিবর্তন করা হয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের। এখন শুরু হয়েছে ভোটগ্রহণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ইভিএমে হবে এই নির্বাচন।
নির্বাচনের আগে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে ‘ডামি ট্রায়াল’ করা হবে। আগামী ২৮শে জুলাই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ নির্বাচন। আর সেটি হচ্ছে সিলেট-৩ আসনে। দেশজুড়ে লকডাউন থাকায় ভোটের দিন এ আসনে লকডাউন শিথিলেরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সিলেট শহরের নিকটবর্তী দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে এ আসনের অবস্থান। আছে করোনার ভয়। ইতিমধ্যে তিন উপজেলায়ই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে হানা দিচ্ছে করোনা। মারা যাচ্ছে মানুষও। এই অবস্থায় সিলেট-৩ আসনের নির্বাচন নিয়ে সব মহলেই ‘কৌতূহল’। গত ২০ দিন ধরে সিলেটের করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। শনাক্তের হার বাড়ছে। একদিনের মৃত্যুরও রেকর্ড ছুয়েছে। সিলেট-৩ আসনের প্রয়াত এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীও করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। করোনাকালীন সময়ে সিলেটে এমপিদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মাহমুুদ উস সামাদ চৌধুরী। করোনায় চারদিক যখন কাবু তখন নিজ এলাকার সাধারণ মানুষকে ছেড়ে চলে যাননি। বরং করোনাকালীন সময়ে মানুষের দুঃখ লাঘবে সবচেয়ে বেশি ত্রাণ বিতরণ করেছেন এলাকায়। করোনাকে পাত্তা না দিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ছিলেন সরব। করোনা আক্রান্ত হয়েই গত ১১ই মার্চ ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার মৃত্যুর পর স্বজনরাই জানিয়েছেন- নিজ এলাকায়ই করোনা সংক্রমিত হয়েছিলেন। ত্রাণ বিতরণ কিংবা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। ঢাকায় ফেরার পথে বিমানেই অসুস্থতা বোধ করেন। এর পর পরই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর এ আসনটি শূন্য ঘোষণা করে উপনির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিলো। প্রথমে ১৪ই জুলাই করা হলেও পরবর্তীতে তারিখ পরিবর্তন করে সেটিকে ২৮শে জুলাই নিয়ে যাওয়া হয়। ৬ই জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়। সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনে প্রথম রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ইসরাইল হোসেন। এ ছাড়া সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফয়সাল কাদিরও ছিলেন। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ, বাছাই, প্রতীক বরাদ্দ সবই করেন প্রথম রিটার্নিং কর্মকর্তা। প্রতীক বরাদ্দের পর পরই রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ইসরাইল হোসেনসহ সিলেটের ৮ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী করোনা আক্রান্ত হন। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা পরিবর্তন করে সিলেটের জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলামকে নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার সঙ্গে তিন উপজেলার তিন ইউএনওকে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হলেও ফেঞ্চুগঞ্জের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় তাকেও বদল করে নতুন কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ঈদের পূর্ববর্তী লকডাউনেও সিলেটে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন প্রার্থীরা। প্রচারণায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লকডাউন হওয়ার কারণে প্রার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রচারণা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিসহ নানা বিষয়ে তদারকি করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়। ঈদের পর গতকাল থেকে ফের শুরু হয়েছে লকডাউন। এই লকডাউনে সিলেটের অন্যান্য উপজেলায় পালন করা হলেও কার্যত সিলেট-৩ নির্বাচনী আসনে সেটি পালন হচ্ছে না। প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটাররা নির্বাচনী প্রচারণায় ঘাম ঝরাচ্ছেন। শেষ মুহূর্তে এসে প্রার্থীরা এলাকায় এলাকায় ছাড়াও বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। করছেন ভোট প্রার্থনা। প্রার্থীদের সঙ্গে সদলবলে নেতাকর্মীরাও যাচ্ছেন। এতে লোক সমাগম বেশি হওয়ার কারণে ভোটাররাও হচ্ছেন বিব্রত। লকডাউনের মধ্যে নির্বাচনকে এ ব্যতিক্রম নির্বাচন বলে অভিহিত করেছে ভোটাররা। তাদের মতে- লকডাউনকালে নির্বাচনে অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। করোনার ভয় তো রয়েছে। যতই স্বাস্থ্যবিধি মানা হোক সচেতন মানুষ কখনোই ভোটকেন্দ্রে যাবে না। এদিকে- লকডাউন ও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিব্রত প্রার্থীরা। এ আসনে এবার মোট চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরা হলেন- আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব, জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিক, বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি, স্বতন্ত্র প্রার্থী আলহাজ শফি আহমদ চৌধুরী ও জাতীয় কংগ্রেসের জুনায়েদ মো. মিয়া। করোনাকালীন সময়ে নির্বাচনের জন্য শুরু থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব। তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘আমরা প্রচারণা, নির্বাচনী কার্যক্রম যা করছি সবই স্বাস্থ্যবিধি মেনে করছি। মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া- বড় বড় সমাবেশও এড়িয়ে চলা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।’ তবে- করোনার কারণে শুরু থেকেই নির্বাচনী প্রচারণায় বেশ সতর্ক স্বতন্ত্র প্রার্থী শফি আহমদ চৌধুরী ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিক। শফি আহমদ চৌধুরী সঙ্গে বহর না নিয়েও অনেকটা একা একাই নির্বাচনী প্রচারণা করছেন। আতিকুর রহমান আতিকের বেলায়ও তাই। তিনি নির্ধারিত সংখ্যক সমর্থকদের সঙ্গে রাখছেন বলে তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতারা জানিয়েছেন। করোনা কালে ব্যতিক্রম এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ইভিএমের মাধ্যমে। সিলেটে এই প্রথম কোনো একটি আসনের সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। ইভিএম ব্যবহার বিধির ডামি নিয়ম ভোটারদের অবগত করতে ২৬শে জুলাই প্রতিটি কেন্দ্রে ট্রায়াল করা হবে। এতে ভোটাররাও উপস্থিত থাকবেন। নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এহসানুল কবীর ফেরদৌস গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- লকডাউনের কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তারা ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রতিটি কেন্দ্রে মাস্ক, গ্লাভস ও হ্যান্ডস্যানিটাইজার বিতরণ করা হচ্ছে। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা এগুলো ব্যবহার করবেন। ভোটাররা হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার করবেন। তিনি জানান- নির্বাচনে প্রার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের প্রচারণার বিষয়টিও মনিটরিং করা হচ্ছে। এদিকে- নির্বাচনে স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিষয়টি নিয়ে ঘোর আপত্তি আছে অংশগ্রহণকারী দলের নেতাদেরও। জাতীয় পার্টির দক্ষিণ সুরমা থানা শাখার সদস্য সচিব তাজ উদ্দিন এপলু জানিয়েছেন- স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হলেও অন্যান্য প্রার্থীরা সেটি করছেন না। করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি ও লকডাউন থাকার কারণে অনেক ভোটারকেই কেন্দ্র পর্যন্ত নেয়া কষ্টকর হবে বলে জানান তিনি।