আটাত্তর বছর বয়সী সফরবান বেগম। শরীয়তপুরের বাসিন্দা এই নারী দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে তার জ্বর ও কাশি শুরু হয়। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। প্রাথমিক চিকিৎসায় জ্বর-কাশি কমলেও শ্বাসকষ্ট কমেনি। অক্সিজেনের লেভেল বিপদসীমার নিচে নেমে যাওয়াতে তার সন্তানেরা দিশাহারা হয়ে যান। পরে গতকাল সকালে তাকে নিয়ে আসেন ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সফরবান বেগমের গুরুতর অবস্থা দেখে মুগদা হাসপাতালের চিকিৎসকরা সাফ জানিয়ে দেন আইসিইউ ছাড়া এই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
এই হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি না থাকায় তাকে অন্যকোনো হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। সফরবানের স্বজনরা তারপর শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চারটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে কোথাও আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করতে পারেননি। পরে তার স্বজনরা বাধ্য হয়েই বেসরকারি কোনো হাসপাতালে আইসিইউ সন্ধানে বের হয়ে পড়েন।
কুমিল্লার তিতাস এলাকার বাসিন্দা সাহেব আলী। ৬৮ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী দুইবার স্ট্রোক করে ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছিলেন তিন বছর ধরে। শরীরে টুকটাক জটিলতা সবসময় লেগেই থাকে। কিন্তু গত শনিবার থেকে আচমকা তার অক্সিজেন লেভেল নিচের দিকে নামতে থাকে। অক্সিজেন সিলিন্ডার বাসায় এনে তাকে সাপোর্ট দেন সন্তানেরা। সাময়িক কিছুটা সুস্থতাবোধ করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অবস্থা জটিল হতে থাকে। অক্সিজেনের অভাবে তার অবস্থা গুরুতর হওয়াতে নেয়া হয় কুমিল্লা সদর হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা সাহেব আলীর স্বজনদের পরামর্শ দেন ঢাকায় গিয়ে কোনো আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করতে। স্বজনরা তড়িঘড়ি করে ঢাকায় এনে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ঘুরে কোনো আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করতে পারেননি।
শুধু সফরবান বেগম কিংবা সাহেব আলী নন। আইসিইউ শয্যা না থাকায় ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলো ভর্তি নিচ্ছে না কোনো জটিল রোগী। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা না পেয়ে অনেকেই রোগীর বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সফরবান বেগমের মেয়ে সুমি বেগম বলেন, আমার মায়ের কিডনিতে সমস্যা আছে। কয়েকদিন ধরে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়াতে স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকায় নিয়ে আসি। ভেবেছিলাম ঢাকায় আনলে কোথাও না কোথাও একটি আইসিউ শয্যা ব্যবস্থা করতে পারবো। কিন্তু শরীয়তপুর থেকে এসে সারা দিন এম্বুলেন্সে এম্বুলেন্সে ঘুরেছি। বিভিন্ন হাসপাতালে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি। কোথাও একটি শয্যার ব্যবস্থা করতে পারিনি। দিনভর এম্বুলেন্সে মা’কে রেখে ২০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়েছি। সাহেব আলীর ছেলে হাসান আলী বলেন, আইসিইউ সাপোর্ট বাবার জন্য খুবই জরুরি। তার শ্বাসকষ্ট খুব বেশি হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলেছেন আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে। কয়েকটা হাসপাতালে ঘুরে কোনোভাবেই ব্যবস্থা করতে পারলাম না। এখন বাধ্য হয়েই বেসরকারি একটি হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা পেয়েছি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকায় সরকারি করোনা ডেডিকেটেড ১৬টি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য কোন আইসিইউ ব্যবস্থা নাই। বাকি ১৩টি হাসপাতালে ৩৮৪টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র ডিএনসি কোভিড হাসপাতালে ২১২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এই হাসপাতালে কিছু আইসিইউ শয্যা খালি আছে। বাকি ১২টি হাসপাতালেই কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নাই। সূত্রগুলো বলছে, ঢাকার কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শ্যামলী টিভি হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধী ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নাই।
হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাইরে আইসিইউ সুবিধা অপ্রতুল হওয়াতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীরা ঢাকায় এসে ভিড় করেন। বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় বেশি থাকায় সরকারি হাসপাতালের আইসিউতে চাপ পড়ে। করোনা পরিস্থিতি ছাড়াও অন্য সময়ও সরকারি হাসপাতালের আইসিউ খালি থাকে না। তবে করোনা পরিস্থিতিতে গুরুতর রোগী বেড়ে যাওয়াতে আইসিইউ চাহিদা বেড়ে গেছে। ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসছেন যাদের অবস্থা গুরুতর। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে যখন রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায় তখন আইসিইউ সাপোর্ট দিয়েও কোনো লাভ হয় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে সীমিত আইসিইউ শয্যা। রোগীর চাপ বেশি। সবসময় পূর্ণ থাকে শয্যা। একটি শয্যা খালি হলে তার বিপরীতে অন্তত ৩০ জন রোগী থাকে। আইসিইউ লাগবে এমন রোগীদের অপেক্ষা করার সময় থাকে না। গুরুত্ব বিবেচনায় আমরা যার বেশি প্রয়োজন তাকেই আইসিইউ দেই। আর যাদেরকে দেয়া সম্ভব হয় না তাদেরকে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেই।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালের করোনা ইউনিটগুলো রোগীতে ঠাসা। সাধারণ রোগীদের শয্যা সংকুলান ও চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জটিল রোগীদের জন্য যে ধরনের সাপোর্ট দেয়া দরকার সেগুলো এখন সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে আইসিইউ সাপোর্ট না থাকার কারণে জটিল রোগী রাখা হচ্ছে না। দিন দিন করোনা পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে হাজার হাজার আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করলেও রোগী সামাল দেয়া কঠিন হবে।