ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে পিয়াজের দাম

Slider অর্থ ও বাণিজ্য জাতীয় টপ নিউজ


কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না পিয়াজের বাজার। রাজধানীর বাজারে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে পিয়াজের দাম। মূল্য বাড়তে বাড়তে প্রতিদিনই নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে পণ্যটি। পিয়াজের কেজি এখন ২৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। বাজারে বড় আকারের একটি পিয়াজের দাম এখন ৪০ থেকে ৭০ টাকা। পিয়াজের এমন দাম বাড়ায় ক্রেতাদের পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতারাও অবাক। এদিকে বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ; মিসর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির ব্যাপারে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য, মন্ত্রীদের আশ্বাস, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান- কোনও কিছুই দাম বৃদ্ধির লাগাম টানা যাচ্ছে না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পিয়াজের আকাশচুম্বী দামের কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ ব্যাপক চাপে পড়েছে। কাওরান বাজারে ঘুরে দেখা যায়, পিয়াজের দাম শুনে মলিন মুখ করে চলে যাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষরা।
অনেককে এক কেজি করে পিয়াজ কিনে ফিরে যেতে দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পিয়াজের জোগান নেই। তারা জানান, দাম বেশি বলে বাজারে ক্রেতাও কম।

জানা গেছে, রাজধানীর পাইকারি ও খুচরাাবাজারে মানভেদে দেখা গেছে, পিয়াজের দাম আগের দিনের চেয়ে বেশি। প্রতি কেজি পিয়াজ ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পিয়াজের ডাবল সেঞ্চুরি দেশে প্রথম। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দেশি পিয়াজের কেজি ১৪০ টাকায় উঠেছিল। সেটাই ছিল এযাবৎকালের সর্বোচ্চ দর।

সূত্র জানায়, ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় গত ২৯শে সেপ্টেম্বর থেকেই দেশের পিয়াজের বাজার অস্থির। এরপর থেকে দফায় দফায় বাড়তে থাকে পিয়াজের দাম। পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সংবাদে ২৯শে সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ১০০ টাকায় পৌঁছায় যায় দেশি পিয়াজের কেজি। খুচরা পর্যায়ে ভালো মানের দেশি পিয়াজ ১০০-১১০ টাকা কেজি বিক্রি হতে থাকে। এরপর বেশ কিছুদিন পিয়াজের দাম অনেকটাই স্থির ছিল। ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে নেমে এসেছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর আবারও হঠাৎ পিয়াজের দাম বেড়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং আমদানি করা পিয়াজ আসছে না- এমন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পিয়াজের দাম বাড়িয়ে দেন।

এরপর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক বক্তৃতায় বলেন, পিয়াজের কেজি ১০০ টাকার নিচে নামা সম্ভব নয়। মন্ত্রীর এই বক্তব্য পিয়াজের দাম বাড়ার বিষয়টিকে আরো উসকে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ১০০ টাকা থেকে পিয়াজের কেজি ১৩০ টাকায় পৌঁছে যায়। এ পরিস্থিতিতে শিল্পমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, পিয়াজের দাম স্বাভাবিক আছে। পরের দিন ওই পিয়াজের কেজি ১৫০ টাকায় পৌঁছে যায়। তবে এখানেই থেমে থাকেনি পিয়াজের দাম বাড়ার প্রবণতা। বুধবার ১৫০ টাকা থেকে এক লাফে ১৭০ টাকা হয়। বৃহস্পতিবার সেই দাম আরো বেড়ে ২০০ টাকায় পৌঁছে যায়। আর সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবার তা আরো বেড়ে ২৫০ টাকায় পৌঁছেছে। এর আগে কখনো দেশের বাজারে এত দামে পিয়াজ বিক্রি হয়নি।

এদিকে ঢাকার সব থেকে বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিশর থেকে আসা পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২১০-২২০ টাকা কেজি। দেশি পিয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৩০ টাকা কেজি।
শ্যামবাজারের সোহেল স্টোরের মালিক বলেন, পিয়াজের দাম অনেক বাড়তি। দেশি পিয়াজ শ্যামবাজারে ২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে, আপনারাও দাম বাড়িয়ে বিক্রি করেন। মিসরের পিয়াজ এখানে ২২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
পপুলার বাণিজ্যালয়ের বিক্রয়কর্মী মিরাজ বলেন, বাজারে পিয়াজ নাই। পিয়াজের ঘাটতির কারণে দফায় দফায় পিয়াজের দাম বাড়ছে। গতকালই পিয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা। এ দাম কোথায় গিয়ে ঠেকে তার কোনো ঠিক নেই।

এদিকে রামপুরার বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিকেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৩০-২৫০ টাকা কেজিতে। পিয়াজের দামের বিষয়ে বিক্রেতা মিলন বলেন, প্রতিদিনই পিয়াজের দাম বাড়ছে। আমাদের করার কিছু নেই। বুধবার শ্যামবাজার থেকে ১৬০ টাকা কেজি পিয়াজ কিনেছি। বৃহস্পতিাবার পিয়াজ কিনতে হয়েছে ২০০ টাকায়। আর গতকাল শ্যামবাজারে পিয়াজ ২৩০ টাকা কেজি। তিনি বলেন, শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীদের কারণেই পিয়াজের দাম বাড়ছে। আর মন্ত্রীদের বক্তব্য পিয়াজের দাম বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। মন্ত্রীরা উল্টো-পাল্টা বক্তব্য না দিলে কিছুতেই পিয়াজের কেজি ২০০ টাকা হয় না।

শান্তিনগর বাজারের ব্যবসায়ীরা পিয়াজের কেজি ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা বিক্রি করছেন। বাজারটির ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যের মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে রাখলেও পিয়াজের ঘর খালি রেখেছেন।
এ বিষয়ে ভাই ভাই স্টোরের ইমরান বলেন, যে মূল্য তালিকা রয়েছে তা আগের দিনের। গকাল আরো বেড়েছে। আগের দিনের তুলনায় গতকাল শুক্রবার পিয়াজের দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার যে পিয়াজ ২০০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। তা গতকাল ২৩০ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে।
নিউমার্কেটে বাজারের ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি পিয়াজ ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা দামে বিক্রি করছেন। এ বাজারটিতেও পিয়াজের মূল্য তালিকা দেখা যায়নি।

ব্যবসায়ী কাউসার বলেন, প্রতিদিনই পিয়াজের দাম বাড়ছে। যে পিয়াজ ২০০ টাকা কেজি ছিল, এখন তা ২৫০ টাকা হয়েছে। পিয়াজের এমন দাম বাড়ায় আমরাও হতবাক।
সেগুন বাগিচা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখানে পিয়াজের এমন লাগামহীন দামে ক্ষোভ ক্রেতাদের মাঝে। পিয়াজের বাজার কারা নিয়ন্ত্রণ করছেন? এই প্রশ্ন সাধারণ ক্রেতাদের।

এই বাজারেরে দোকানদার শাকিল বলেন, তার দোকানে সকাল থেকে ২৪০ টাকা করে পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতেও তিনি ২০০ টাকা করে বিক্রয় করেছেন। তিনি জানান, আগে ২০ টাকা ইনভেস্ট করে কেজিতে ৩ টাকা লাভ করতাম আর এখন ১৯৫ টাকা ইনভেস্ট করে ৫ টাকা লাভ করি। আগে সবাই ১ কেজি ২ কেজি করে পিয়াজ কিনতো। এখন আড়াইশো গ্রাম, আধা কেজি করে কেনে। এই জন্য আমাদের বিক্রিও কম, লাভও কম।

সেগুন বাগিচা এলাকার আহমেদুল কবির বলেন, ফলের দামের চেয়ে পিয়াজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা বিপাকে পড়ে গেছি। নিত্য প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে এবং এটি স্থায়ীত্ব লাভ করলে জনগণ বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

এদিকে দেশি পিয়াজের মতোই লাফিয়ে বেড়েছে মিয়ানমার, তুরস্ক ও মিসরের পিয়াজের দাম। আগের চেয়ে গতকাল সব পিয়াজেরই দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। এমনকি চীনা পিয়াজও বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা কেজি দরে।

এদিকে বাজারে বড় আকারের পিয়াজ আমদানি হচ্ছে চীন ও মিসর থেকে। লাল বা কালচে লাল রঙের একেকটি পিয়াজের ওজন ২০০ থেকে ৩৫০ গ্রাম পর্যন্ত। কেজিপ্রতি ২০০ টাকা দাম হিসাব করে বড় আকারের একটি পিয়াজের দাম পড়ছে ৪০ থেকে ৭০ টাকা। এ রকম বড় আকারের তিন থেকে ৫টি পিয়াজের ওজন মিলিয়ে এক কেজি হয়। লাল রং ছাড়াও হলুদ রঙের গোলাকার পিয়াজ আসছে চীন থেকে। একেকটি পিয়াজের ওজন ৭০ থেকে ১২০ গ্রাম। এ হিসাবে ১২-১৪টি পিয়াজে এক কেজি হয়। এ ধরনের পিয়াজের সরবরাহ কম।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও পিয়াজের দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম বেড়েছে গড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ। আর এক মাসে বেড়েছে সাড়ে ৫ ও এক সপ্তাহে আড়াই শতাংশের মতো। তবে বাংলাদেশে বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি হারে বাড়ছে পণ্যটির দাম। গত এক বছরে ৩৫২ ও এক মাসে ৬৪ শতাংশ বেড়ে দেশে পাইকারিতেই প্রতি কেজি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৭০ টাকায় (২ ডলার), যা বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *