নিখোঁজ রহস্যও খোঁজহীন

Slider টপ নিউজ


২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল বিকালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে অস্ত্রের মুখে ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ অপহরণকা- নিয়ে সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে আলোড়ন। ৩৫ ঘণ্টা পর মুক্তি পান তিনি। ১৭ এপ্রিল রাত ১২টার দিকে রাজধানীর মিরপুরের আনসার ক্যাম্পের সামনের সড়কে চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় আবু বকর সিদ্দিককে ছেড়ে দেওয়া হয়; ছেঁড়া শার্টের পকেটে গুঁজে দেওয়া হয় ৩০০ টাকাও। সেন্ট্রাল রোডের বাসার উদ্দেশে সিএনজি অটোরিকশায় ওঠেন তিনি। রাত দেড়টার দিকে কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টারের সামনের সড়কে পুলিশের একটি চেকপোস্টে থামানো হয় তাকে বহনকারী অটোরিকশা; তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ধানমন্ডি থানায়। কিন্তু বিপর্যস্ত আবু বকর সিদ্দিক কিংবা তার পরিবারের আতঙ্কগ্রস্ত সদস্যদের কেউ তখন তার নিখোঁজ থাকাকালীন সময় নিয়ে কিছু বলতে চাননি। পরেবর্তী সময়েও তারা আর এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। এ কান্ডে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হলেও এর রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি রহস্যজনক কারণে।

আবু বকর সিদ্দিকের মতো অনেকেই অপহরণসহ নানাভাবে নিখোঁজ হন। নিখোঁজ এসব মানুষের মধ্যে পরবর্তী সময়ে অনেকেরই লাশ উদ্ধার হয়েছে; কেউ কেউ ফিরেও এসেছেন। আবার এ পর্যন্ত সন্ধান মেলেনি এমন নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। ব্যবসায়ী, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, চাকরিজীবী, ধর্মীয় বক্তা, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন এ তালিকায়। ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, কখনো সাদা পোশাকে, কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাদের স্বজনদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সর্বশেষ গত ১০ জুন রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন ইসলামী বক্তা আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনান। ওইদিন রাতে ঢাকার একটি মসজিদে খুতবা দেওয়ার উদ্দেশে রংপুর থেকে বিকাল চারটার দিকে ভাড়া করা একটি গাড়িতে ঢাকায় রওনা দেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন তার দুই সঙ্গী আবদুল মুহিত ও ফিরোজ এবং গাড়িচালক আমির উদ্দিন ফয়েজ। রাত ২টা ৩৬ মিনিটে আদনানকে তার স্ত্রী সাবেকুন্নাহার ফোন দিলে আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনান জানান, তিনি এখন ঢাকার গাবতলীতে আছেন। মুঠোফোনের চার্জও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এর পর থেকে আদনানসহ সবার মুঠোফোনই বন্ধ ছিল। আবু ত্ব-হা নিখোঁজ হওয়ার পর তার মুক্তির দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। গত শুক্রবার তার সন্ধান মেলে। পুলিশ দাবি করে, ‘ব্যক্তিগত কারণে’ গাইবান্ধার ত্রিমোহনী এলাকায় বন্ধু শিহাবের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান। তার সঙ্গীরাও সেখানে ছিলেন। ঘটনার দিন রাতে রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে তারা গাইবান্ধা চলে যান বলে তাদের বরাত দিয়ে বলছে পুলিশ। তবে বরাবরের মতো এ ঘটনায়ও আবু ত্ব-হা মুখ খোলেননি। নিখোঁজ থাকাকালীন সময়ের বিষয়ে তিনি নিজে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি।

নিখোঁজ হওয়ার এসব ঘটনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তালিকায় গুম হিসেবে স্থান পাচ্ছে। এমনকি করোনাকালেও থেমে নেই এসব কা-। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে করোনার মধ্যেও ৬ জন গুমের শিকার হয়েছেন। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে গুমের শিকার ৩ জন।

ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে আসক-এর তথ্যানুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০২০ (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে পরবর্তীকালে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছেন। অবশিষ্টদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কারও কাছে।

বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এ পর্যন্ত তাদের ৬০০ নেতাকর্মী গুম বা নিখোঁজ হয়েছেন। পরবর্তীকালে অনেকের লাশ পাওয়া গেছে। কেউ কেউ ফিরেও এসেছেন। ২০১৩ সালে ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনকে। এর পর থেকে এ পর্যন্ত তার খোঁজ আর মেলেনি। পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার স্বামীর খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো। এ দম্পতির রীতি (৯) ও আরাফ (৭) নামে দুই সন্তান রয়েছে। পারভেজের স্ত্রী ফারজানা আক্তার আমাদের সময়কে জানান, পারভেজ হোসেন গুম হওয়ার সময় রীতির বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। আর ছেলে আরাফ তখন মায়ের গর্ভে। আরাফ জন্ম নিয়ে বাবাকে দেখতে পারেনি। ডাকতে পারেনি বাবা বলে।

দুই বছরের রীতির বয়স এখন নয় বছর। ছোট্ট রীতি বলেন, ‘আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করছি।’

২০১৬ সালের ১৬ মার্চ রাতে রাজধানী থেকে নিখোঁজ হন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা। ঘটনার পাঁচ দিন পর তাকে উদভ্রান্ত অবস্থায় বিমানবন্দর সড়কে হাঁটতে দেখে পুলিশ বাড়ি পৌঁছে দেয়। অন্যদের মতো তানভীর হাসান জোহাও তখন নিখোঁজ রহস্য নিয়ে কথা বলেননি।

গতকাল এ বিষয়ে জানতে তানভীর হাসান জোহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘যেভাবেই হোক নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে ফিরে আসেন। এটি ভালো দিক। আর যারা ফিরে আসেন না এটি দুঃখজনক। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।’

২০১৫ সালে ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ। নিখোঁজের ৬২ দিন পর ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে উদ্ধার হন তিনি। ১২ মে তিনি মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল থেকে তার স্ত্রী হাসিনা খানকে ফোন করেন। ভারতীয় পুলিশের বরাতে বলা হয়, মেঘালয়ের গলফ গ্রিন এলাকায় ঘোরাঘুরির সময় পুলিশ তাকে আটক করে। সে সময় তাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছিল।

সালাউদ্দিন শিলংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি নিজে ভারতে আসেননি। যারা তাকে অপহরণ করেছিল, তারাই তাকে ভারতে রেখে গেছে। তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে চাননি।

চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদ, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় রাকিবুল ইসলাম রকি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান, আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা শামীম আহমেদ, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়সহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ নিখোঁজ হন। এদের মধ্যে ফিরে আসা ব্যক্তিদের কেউই বিষয়টি নিয়ে পরে আর মুখ খোলেননি।

২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুর এলাকার এক আত্মীয়র বাসা থেকে ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজা পিন্টুকে তুলে নিয়ে যান অস্ত্রধারীরা। এ সময় তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কালো কাচের একটি সিলভার রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। নিখোঁজ সেলিম রেজা সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন। নিখোঁজের পর থেকে সেলিমের সন্ধানে তার পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো ফল পাননি। এখন শুধু অপেক্ষাই পরিবারটির একমাত্র করণীয়।

এ ঘটনায় ২০১৫ সালে রাজধানীর পল্লবী থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে আদালতে মামলা করে পরিবার। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে সেলিম রেজাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ পায়। তবে এ ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি।

অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে মানুষ গুম হওয়ার অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন, গুম বলে কিছু নেই। অনেকে মামলার আসামি, গ্রেপ্তার এড়াতে নিজ থেকে আত্মগোপন করেন। কেউ কেউ ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় পালিয়ে বেড়ান। পরিবার তা গুম বলে প্রচার করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অপরাধ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘বিভিন্ন সময় যারা গুম হন অথবা নিজে থেকে আত্মগোপনে চলে যান তাদের পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে পরিবেশ বা পরিস্থিতির মধ্যে খুঁজে পান সেটি খুব আপত্তিকর। কারণ এর প্রভাব পড়ে পরবর্তী ঘটনার ওপর। এ কারণে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তি উদ্ধারের পর নিখোঁজের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *