ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার একটি রিসোর্টে নারী পাচারের জন্য ৮০০ তরুণ-তরুণী পুল পার্টি!

Slider টপ নিউজ


ঢাকা: রাজধানীর মগবাজারের নয়াটোলা এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনে মা-বাবার সঙ্গে বাস করতেন রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে ‘টিকটক হৃদয়’। বাড়িটি তাদেরই। অধিকাংশ সময় বাসাতেই থাকতেন এ যুবক। নিজের রুমে দিন-রাত ফেসবুকিং আর টিকটক নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। টিকটক সেলিব্রেটি হৃদয় তার কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হতো কালে-ভদ্রে। তাই মহল্লাবাসী তাকে ভদ্র বলেই জানতেন। তারা ভাবতেই পারেননি টিকটক-লাইকির আড়ালে নারীপাচারের কত বড় ফাঁদ পেতেছিলেন হৃদয় বাংলাদেশে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু অপরাধীর সঙ্গে জোট বেঁধে ঢাকায় গড়ে তুলেছিলেন তিনি আন্তর্জাতিক নারীপাচারের শক্ত নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইসহ কয়েকটি দেশে বিস্তৃত। ফেসবুক, টিকটক আর লাইকিতে পরিচিত হয়ে প্রেমের ছলনা আর চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কতশত তরুণী ও কিশোরীকে ঘরছাড়া করে অবৈধ পথে বিদেশে নিয়ে বেঁচে দিয়েছেন তিনি। টিকটক-লাইকির ভিডিও তৈরির মাধ্যমে আয়ের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলে তাদের ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত করে বিভিন্ন দেশে পার্লার, সুপার শপ কিংবা বড় শপিংমলে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে দিয়েছেন। সেখানে তাদের নির্যাতন করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করেছেন হৃদয়। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা।

সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া নির্যাতনের পর গণধর্ষণের শিকার ওই তরুণীকেও বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে পাচার করে একটি যৌনপল্লীতে বিক্রি করেছিল টিকটক হৃদয়। এর আগে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করে স্বামীর ঘর থেকে বের করে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে নিয়ে পাচার করে দেয় সে। এভাবে অসংখ্য তরুণীর জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে হৃদয়হীন টিকটক হৃদয়। নারী পটানোর মাধ্যম হিসেবে হৃদয় মূল হাতিয়ার ব্যবহার করত ফেসবুক, টিকটক ও লাইকি।

সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু ভারতের কেরালায় নিখোঁজ এক বাংলাদেশি তরুণীকে বিবস্ত্র করে দলবেঁধে অমানসিক যৌন নিপীড়নের পর সেই দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ভাইরাল করে এখন ল-ভ- হৃদয়ের নারীপাচারের নেটওয়ার্ক। গত বৃহস্পতিবার চক্রের পাঁচ সদস্যসহ বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে ভয়ঙ্কর এই মানুষ বিকিকিনির কারবারি। গ্রেপ্তারকালে পালাতে উদ্যত হলে হৃদয়ের পায়ে গুলি করে পুলিশ। আহত হৃদয় এখন সেখানকার একটি হাসপাতালে পুলিশি হেফাজতে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে দুই দেশে। ২০১৪ সালে হৃদয়ের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় ডাকাতির প্রস্তুতির বিষয়েও একটি মামলা হয়েছিল।

এদিকে ভারতে বীভৎস কায়দায় ওই তরুণীকে অমানসিক যৌন নির্যাতনের সেই দৃশ্য সম্প্রতি নেটদুনিয়ায় ভাইরাল হলে সুর পাল্টে ফেলেন হৃদয়ের মা মিনু আক্তার ও বাবা আবুল হোসেনসহ পরিবারের সদস্যরা। নিরীহ ও সুবোধ বালক হৃদয় এখন তাদের কাছে বখে যাওয়া যুবক! আইনের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে হৃদয়কে কয়েক মাস আগে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয় বলে চাউর করতে চাইছে ওদের পরিবার। নির্যাতনের ভিডিও ভাইরালের পর মহল্লাবাসীর কাছে ভিলেনে পরিণত হয়েছে এতদিনের ‘হিরো’ হৃদয়। পুলিশের তথ্য ছাড়াও গতকাল শনিবার হৃদয়দের নয়াটোলার বাড়িতে গিয়ে এবং দিনভর মহল্লার অনেকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে ভারতে পাচারকারীদের বন্দিদশা থেকে নির্যাতিত ওই তরুণীকে যে কোনো মূল্যে ফেরত চেয়েছেন তার দরিদ্র মা-বাবা।

জানা গেছে, ভারতে যৌন নির্যাতনের শিকার তরুণীর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর থানা এলাকায়। দরিদ্র পরিবারের মেয়েটির লেখাপড়া এগিয়েছে মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ২০১৪ সালে প্রেম করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের কুয়েত প্রবাসী এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে ওই তরুণীকে শ্বশুরবাড়ির কেউ মেনে না নেওয়ায় তাকে বিভিন্ন সময় শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন ও অত্যাচার সহ্য করতে হতো। যে কারণে তিনি বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পর্যন্ত বাবার বাড়ি কিশোরঞ্জে থাকতেন। প্রবাসী স্বামীও কোনো খোঁজখবর নিতেন না। বাবার আর্থিক অনটনের কথা চিন্তা করে ওই তরুণী সৌদি আরব যাওয়ার চিন্তা করেন। ঢাকায় কয়েক মাস হাতিঝিল এলাকায় ছিলেন। এখানে থাকাবস্থায় সৌদি যাওয়ার জন্য একবার এক দালালকে ৩০ হাজার টাকাও দেন ওই তরুণী ও তার বাবা। দালাল তাদের টাকা আত্মসাৎ করলে তরুণী কাউকে কিছু না জানিয়ে মাস কয়েক আগে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যান চার বছরের এক পুত্রসন্তানের এ জননী। ছেলেটি বর্তমানে চাঁদপুরে তার দাদা-দাদির কাছে রয়েছে। টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে ওই তরুণীর পরিচয় হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। প্রেম-ভালোবাসার পর হৃদয় তাকে ভালো বেতনে চাকরিসহ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পাচার করে। এর পর সেখানে যৌন ব্যবসা করতে বাধ্য করা হয় তাকে। দেশে থাকাবস্থায় তার বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে রমনা থানায় ডাকাতি প্রস্তুতি মামলা হয়েছিল।

গতকাল বিকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ তার কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হৃদয়ের বিষয়ে বিস্ফোরক তথ্য দেন। পুলিশের এ ডিসি বলেন, ‘টিকটক হৃদয় বাবু’ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু অপরাধীর সঙ্গে মিলে মানবপাচারের আন্তর্জাতিক চক্র গড়ে তুলেছিল। চক্রটির নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইসহ কয়েকটি দেশে বিস্তৃত। মূলত পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের ভারতে পাচার করত হৃদয়ের চক্র। ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু হোটেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিল চক্রটি। হোটেলগুলোতে চাহিদামতো বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের নিয়মিতভাবে সরবরাহ করা হয় বলে তথ্য মিলেছে।

তিনি আরও জানান, এই চক্রের সদস্যরা মূলত স্কুল-কলেজের বখে যাওয়া ছেলেমেয়েদের টার্গেট করত। বিশেষ করে টিকটক গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে তারা পাচার কাজে সহযোগিতা করছিল। টিকটক হৃদয় টিকটকের একটি গ্রুপের অ্যাডমিন। সেই গ্রুপের মাধ্যমে ২০২০ সালের শেষের দিকে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার একটি রিসোর্টে প্রায় ৮০০ তরুণ-তরুণী পুল পার্টিতে অংশ নেয়। মূলত টিকটক ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে তরুণ-তরুণীরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে একটি ফেসবুক গ্রুপে সংযুক্ত হয়। যে ফেসবুক গ্রুপটির মূল পৃষ্ঠপোষক নারীপাচারের এ আন্তর্জাতিক চক্রটি।

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, এই গ্রুপে সুনির্দিষ্ট কিছু যুবক গ্রুপের নারী সদস্যদের ভারতের বিভিন্ন মার্কেট, সুপার শপ, বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির অফার দিয়ে প্রলোভনে ফেলে পাচার করছিল। চক্রটির মূল আস্তানা হচ্ছেÑ ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায়। চক্রের সদস্যরা পাচার করা বিভিন্ন বয়সী মেয়েকে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুরায় নিয়ে যাওয়ার পর কৌশলে নেশাজাতীয় বা মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে বা জোর করে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করত। পরবর্তী সময়ে সেই ভিডিও দেখিয়ে বলা হতো, অবাধ্য হলে বা পালানোর চেষ্টা করলে এসব কুকীর্তির ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। চক্রটি ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু হোটেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। হোটেলগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন বয়সের মেয়েকে নিয়মিতভাবে সরবরাহ করা হয় বলে তথ্য রয়েছে।

ডিসি শহিদুল্লাহ আরও বলেন, ‘টিকটক হৃদয়’ রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা। নির্যাতনের শিকার মেয়েটিও ওই এলাকায় থাকতেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে হৃদয়। এর পর পড়াশোনা ছেড়ে বন্ধুদের সঙ্গে টিকটক ভিডিও তৈরিতে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশি এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ভারত ও বাংলাদেশে পৃথক মামলা হয়েছে। বাংলাদেশের মামলার প্রধান আসামি টিকটক হৃদয়। নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ দ্রুততার সঙ্গে তদন্তে নেমে আসামি ও ভিকটিমকে শনাক্ত করে। ইতোমধ্যে ভারতে ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছে। তারা সবাই আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্রের সদস্য। ওই ঘটনায় ভারতে গ্রেপ্তার ছয়জনের মধ্যে হৃদয়সহ পাঁচ বাংলাদেশি অবৈধভাবে সে দেশে অনুপ্রবেশ করেছিল কোনো পাসপোর্ট ছাড়াই। সে ক্ষেত্রে ভিসার প্রশ্ন তো আসেই না।

টিকটক হৃদয় মানবপাচার চক্রের একজন সাপ্লায়ার বা সমন্বয়ক জানিয়ে ডিসি শহিদুল্লাহ বলেন, আলোচিত ওই তরুণীসহ বাংলাদেশ থেকে আরও বেশ কয়েকজনকে বিভিন্ন দেশে হৃদয় পাচার করেছে বলে তথ্য রয়েছে। তদন্তসাপেক্ষে জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মানবপাচার ও পর্নোগ্রাফি মামলায় এনসিবির মাধ্যমে দ্রুততর সময়ে গ্রেপ্তারদের ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলেও পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *