এলএসডির মূল গ্রাহক উচ্চবিত্তের সন্তানরা

Slider বাংলার মুখোমুখি

এলএসডিকে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মাদকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর বলা হয়। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডির ব্যবহার রয়েছে। তবে বাংলাদেশে এটির ব্যবহার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। মাইক্রোগ্রামেই (১ গ্রামের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ) নেশা হওয়া এ মাদকের বিস্তারে তৈরি হয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ।

এটি দেশে বেচাকেনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি ডার্ক ওয়েব ও বিটকয়েনের ব্যবহার হওয়ায় চক্রটি শনাক্ত আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এলএসডির বিস্তার রোধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে।

২০১৯ সালে দেশে প্রথমবারের মতো উদ্ধার হওয়া এই মাদক সেবনকারীরা মূলত উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। যাদের বড় একটি অংশ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ শেষে ফেরার সময় এটি নিয়ে আসে।

সম্প্রতি এলএসডি মাদকের বিষয়টি আলোচনায় আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পর। পুলিশ সূত্র বলছে, এটি সেবনের পর নিজের গলায় দা দিয়ে আঘাত করেন তিনি। বিষয়টি সামনে এলে দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থাও এই মাদকের বিস্তার নিয়ে নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে।

এতে উঠে আসছে সংঘবদ্ধ বিশাল এক সিন্ডিকেটের নাম। এদের বেশিরভাগই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যারা এক সময় কৌতূহলের বশে এই মাদকটি গ্রহণ করে এখন তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পরে হচ্ছে মৃত্যুপথযাত্রী। দামি মাদক হওয়ায় অর্থ সংগ্রহে একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েছে ব্যবসায়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র বলছে, এলএসডির সঙ্গে সম্পৃক্ত এ পর্যন্ত যারা শনাক্ত হয়েছে পারিবারিকভাবে তাদের বড় অংশই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আছেন। থাকেন গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির মতো অভিজাত সব এলাকায়। বন্ধুদের প্ররোচনায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপ থেকেই তারা এ নেশার খবর পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই বছর আগে দেশে প্রথমবারের মতো উদ্ধার হওয়া এই মাদক আনা হয়েছিল কানাডা থেকে। সরকারের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার ছেলে ইয়াসের রিদওয়ান আনান (২০) এটি নিয়ে এসেছিলেন। এ ঘটনায় কাফরুল থানায় সে বছরের ১৫ জুলাই একটি মামলা হয়। মামলা নং-২১। তদন্ত শেষে এটির চার্জশিট দেওয়া হয়। যা বিচারাধীন রয়েছে।

উদ্ধারকারী সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা তখন ভাবতেও পারেনি যে, এটা আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর কারণ হিসাবে তারা বলছেন, প্রথমত দেশে মাদকটির উৎপাদন নেই এবং দ্বিতীয়ত এটির দাম খুবই বেশি। ফলে এটি সহজলভ্য হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। যদিও এখনো এটি সহজলভ্য নয়, তবে সেবনকারীর সংখ্যা বেড়েছে। যা খুবই মারাত্মক বার্তা বয়ে আনতে পারে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে মাদকটির ব্যবহার আছে। এটা আমাদের কাছে অনেকটাই নতুন। এটা মাইক্রোগ্রাম হিসেবে ব্যবহার হয়। অত্যন্ত শক্তিশালী এ মাদক মানবদেহের ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। এগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশে আসছে। ডার্ক ওয়েব ও বিটকয়েনের ব্যবহার হচ্ছে এখানে। এটি ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তালিকাভুক্ত মাদক। এটির বিস্তার রোধে নতুন করে প্রতি জেলায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

যেভাবে আসছে ও বিস্তার ঘটছে : প্রথমবারের মতো দেশে যখন মাদকটি উদ্ধার হয় তখন এটি দেশের বাইরে থেকে এসেছিল। সেবনকারী নিজেই সেটি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এবার দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। বুধবার ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া এলাকায় অভিযানে এলএসডি মাদকসহ যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয় তারা সেটি নেদারল্যান্ডস থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আনেন। এজন্য ‘টেলিগ্রাম’ অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। অর্থ পরিশোধ করেন অনলাইন লেনদেন মাধ্যম পেপ্যালে।

মেইল ও চিঠির মাধ্যমে ডাকটিকিটের মতো দেখতে এই মাদকটি ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় একটি ব্লট ক্রয় করত চক্রটি। মাদকটি সেবন করেছেন এমন তিনজনের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। তাদের প্রত্যেকেই জানান, মূলত বন্ধু ও ফেসবুকের কয়েকটি গ্রুপ থেকে এর বিষয়ে শুনেছেন তারা। তখন কৌতূহলের বশে গ্রহণ করেন মাদকটি। তারা এগুলো দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসেন বলেও জানান। এই সেবনকারীরা জানান, দেশেও বিভিন্ন গ্রুপ ও মাধ্যমে এলএসডি সংগ্রহ করা যায়।

তাদের কথার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, বেশ কিছু সক্রিয় ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এই মাদকটি বিক্রি করা হতো। পাশাপাশি কয়েকটি ওয়েবসাইটেও বিক্রি হতো এটি। ‘ক্লিকবিডিডটকম’ নামের একটি সাইটেও দেখা গেছে এলএসডি বিক্রির বিজ্ঞাপন। যেখানে বিক্রির স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাজধানীর গুলশানের নাম। ২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে তারা সেলার হিসেবে নিবন্ধিত বলেও ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, এলএসডি মেক্সিকো থেকে আনা হয়েছে।

ইংরেজিতে এর বর্ণনায় বলা হয়েছে, এটা আসল এলএসডি এবং খেলে রাজার মতো অনুভব হবে। সরাসরি যোগাযোগের জন্য দেওয়া আছে মোবাইল নম্বরও। ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, সর্বশেষ বুধবার আটক হওয়া চক্রটির বিক্রির প্ল্যাটফরম ছিল ফেসবুক। তাদের একটি ফেসবুক আইডি রয়েছে। যার নাম ‘আপনার আব্বা’ এবং একটি গ্রুপ আছে যার নাম ‘বাটার, ব্রাউনি এন্ড বিয়ন্ড’। এই গ্রুপে এক হাজার সদস্য রয়েছে।

গ্রেফতার সাদমান, আসহাব ওয়াদুদ ও আদিব আশরাফ এই তিনজন একত্রে এই ফেসবুক আইডি ও গ্রুপের মাধ্যমে মাদকটি বিক্রি করতেন। এটি নতুন ও দামি মাদক হওয়ায় তারা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায় ক্রেতাদের কাছে বিক্রয় করত।

যেভাবে গ্রহণ করা হয়, ক্ষতি কী : এই মাদকটির তিন ধরনের ব্যবহার আছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা যুগান্তরকে বলেন, এই মাদক ইনজেক্টেবল, ট্যাবলেট এবং লিকুইড- এই তিনভাবেই গ্রহণ করা হতে পারে। মাইক্রোগ্রাম সেবনেই এটা শরীরে মারাত্মক প্রভাব তৈরি করে। এটি সেবনের ফলে মতিভ্রম তৈরি হয়। নিজেকে মানুষ সুপারম্যান ভাবতে শুরু করে। শুরুতে এটা ভালো অনুভূতি দিলেও পরে খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, লাইসারজিক অ্যাসিড থেকে তৈরি করা হয় এলএসডি। বিভিন্ন দানাদার শস্যে থাকা এরগোট ছত্রাক থেকে সেটা তৈরি হয়। এটি এতটাই মারাত্মক যে ১৯৩৮ সালে বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণে এলএসডি তৈরির পর তা ঠোঁটে নিয়ে ভয় পেয়ে যান এর উদ্ভাবক আলবার্ট হোপম্যান। এটি ব্যবহারের এক পর্যায়ে বড় দুর্ঘটনা, বিষণ্নতা, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দাসহ নানা সমস্যা তৈরি করে। প্রভাব ফেলে মানুষের হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা এবং শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে।

তিনি আরও বলেন, এই মাদকের ধরনটা নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এর আলামত সংরক্ষণও এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সামান্য একটা কাগজে এটা এমনভাবে বহন করা হয় সাধারণভাবে তা বোঝারও সুযোগ নেই।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার জানান, এটি ব্যয়বহুল এবং অতিরিক্ত ক্ষতিকারক মাদক। এলএসডি সেবন করে কেউ যদি গান শোনে তার সামনে গানের মিউজিকগুলো বিভিন্ন রংয়ের মতো ঘুরতে থাকবে। সেবনকারী অত্যন্ত আক্রমণাত্মক আচরণ করে। একটি এলএসডি ব্লট সেবন করলে ৮-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত সেবনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রতিক্রিয়া থাকে। সেবনকারী নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবে। সেভাবে সে উড়তে পারে। তার অতীত স্মৃতি চলে আসে। অনেকে বলেছে, এটি সেবনের পর তারা মনে করে যে তারা ট্রেনকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *