মিরাজ (ছদ্মনাম) ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। কৃষি দিনমজুর বাবার আয়ে চলে তাদের পরিবার। মিরাজকে ঢাকায় প্রাইভেট-টিউশনির টাকায় লেখাপড়াসহ পরিবারকেও সাহায্য করতে হতো। এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় মিরাজের ঢাকায় টিউশনি বন্ধ। আবাসিক হল বন্ধ থাকায় তাকে গ্রামের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। অন্যদিকে তার ডিজিটাল ডিভাইস না থাকায় এবং ইন্টারনেট ব্যয় মেটাতে না পেরে নিজেও অনলাইন ক্লাসে যুক্ত থাকতে পারেননি। এখন মিরাজ তার ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় ভুগছেন। মিরাজ জানান, করোনা মাহামারী আর লকডাউনে আমার বাবার উপার্জন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বাসায় থাকার কারণে বাবার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে এবং আমি এখনই ঢাকায় যেতে পারছি না। ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারিনি, পরীক্ষাটি মহামারীর জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এই মুহূর্তে আমি চাকরির জন্যও আবেদন করতে পারব না। আমি জানি না এত কঠিন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। জুঁই আক্তার (ছদ্মনাম)। জুঁইও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ইতিহাসের শিক্ষার্থী। একজন হাসিখুশি মেয়ে। তিনি মহামারীর আগে আনন্দিত ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় অংশগ্রহণ করতেন। তবে এখন তার কোনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন না এবং ক্যাম্পাস ছেড়ে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে হতাশায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন তার অভিভাবক। মিরাজ ও জুঁইয়ের এমন হাজার ঘটনার মধ্যে মাত্র দুটি। দেশে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর প্রতিনিয়ত ঘটছে। শিক্ষার্থীদের এমন মানসিক স্বাস্থ্য সমাধানে করোনা মহামারীর এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও সরকার এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অবশ্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা প্রতিটি জেলায় একজন করে ৬৪ জন মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেবেন। তবে এখনো কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। কোনো কোনো বিশ^বিদ্যালয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক কেন্দ্র গঠন করেছে, তবে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে এবং সেবার জনবল যথেষ্ট নয়। মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা মনে করেন, একাকী জীবন, কষ্ট, সঠিক তদারকির অভাব, একাডেমিক জীবন শেষ হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ এবং চাকরি না পাওয়া শিক্ষার্থীদের হতাশা ও মানসিক চাপের কারণ। তারা সারাদেশে দক্ষ মনোবিজ্ঞানী তৈরির জন্য এ বিষয়ে আরও শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ বিষয়ে
বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম আমাদের সময়কে বলেন, করোনা মহামারীজনিত কারণে জনগণ দরিদ্র হয়ে পড়ছে এবং তাদের মূলধন ও চাকরি হারাচ্ছে। এটি সরাসরি ছাত্রদের জীবনকে প্রভাবিত করে। ফলে শিক্ষার্থীরা হতাশায় পড়েছে। তিনি বলেন, দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানীদের অভাব রয়েছে। অল্প লোকবলের মাধ্যমে বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ করা অসম্ভব। এমনকি নতুন প্রশিক্ষণও সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের কোনো পথ দেখছি না।
মেহতাব খানম আরও বলেন, মনোসামাজিক চিকিৎসা অন্য চিকিৎসাগুলোর তুলনায় আলাদা এবং কখনো কখনো অনেক কঠিন। চিকিৎসা দেওয়ার আগে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে অবশ্যই রোগীর মানসিক অবস্থা অনুধাবন করতে হবে। অন্যথায় কখনো কখনো চিকিৎসা রোগীদের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। তিনি বলেন, দেশে প্রায় ৩০০ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ৫০০ জনেরও কম মনোবিজ্ঞানী রয়েছেন। এমনকি মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেরই কাক্সিক্ষত মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাও নেই।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন ‘পুলসওয়ান’-এ গত বছর প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মধ্যে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব চলাকালীন মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে এক গবেষণা নিবন্ধ অনুসারে ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশায় রয়েছেন, ৭১ শতাংশ উদ্বেগ এবং ৭০ শতাংশ মানসিক চাপের মধ্যে নিমজ্জিত। গবেষকরা ২০২০ সালের এপ্রিলে ইন্টারনেটভিত্তিক সমীক্ষা চালিয়েছিলেন, যার মধ্যে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৩ হাজার ১২২ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এ জরিপে অংশ নিয়েছিলেন।
‘বাংলাদেশের স্ট্রেসারস এবং মানসিক স্বাস্থ্য : বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের আশা’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- বাংলাদেশের চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। এটি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, তরুণদের মানসিক চিকিৎসক গ্র্যাজুয়েট তৈরির জন্য প্রণোদনা প্রয়োজন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘আসলে সব শিক্ষার্থীকে সুষ্ঠুভাবে সেবা দেওয়ার জন্য আমাদের আরও জনশক্তি প্রয়োজন।’
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের প্রোভিসি প্রফেসর ড. শামসাদ মর্তুজা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একজন মনোবিজ্ঞানী রয়েছেন। একজন মনোবিজ্ঞানী দ্বারা হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সমস্যা শনাক্ত করা অসম্ভব। তিনি বলেন, সরকার নতুন জনশক্তি তৈরির জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যারা সারাদেশে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে আমাদের অবশ্যই একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক মিঠুন কুমার সাহা জানান, তারা ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত তার বিভাগে কোনো মনোবিজ্ঞানী নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান জানান, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ সেবা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো শুনতে এবং তা সমাধানে তাদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছি।
প্রতিটি জেলায় একজন করে মনোবিজ্ঞানী : দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দেখাশোনা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিটি জেলায় মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল। এ ছাড়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এক লাখেরও বেশি শিক্ষককে প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে উদ্যোগটি এখনো শুরু হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, তারা চলমান লকডাউনের প্রশিক্ষণ শুরু করতে পারেন না। তিনি বলেন, আমরা লকডাউন শেষে প্রশিক্ষণ শুরু করব। প্রতিটি জেলায় একজন মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ করা খুব দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এতে সময় লাগবে।