কঠোর সরকার আপাতত কর্মসূচি দেবে না হেফাজত পর্দার আড়ালে কী হচ্ছে

Slider রাজনীতি


সরকারের কঠোর অবস্থানের মধ্যেই গত সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বৈঠক ঘিরে নানা আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। নানা প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। কেউ কেউ ধারণা করছেন, পর্দার আড়ালে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সমঝোতা হতে যাচ্ছে। যদিও এটি স্রেফ ধারণাই। কারণ সমঝোতার বিষয়ে সরকার কিংবা হেফাজতের নেতৃস্থানীয় কোনো নেতা মন্তব্য করছেন না। বিশ্বস্ত কোনো সূত্রেও কোনো রকম আভাস মিলছে না; রাখঢাক চলছে দুপক্ষের মধ্যেই।

এদিকে সোমবার রাতের ওই বৈঠকের পর গতকাল মঙ্গলবার বিকালে পুলিশ আরও একজন হেফাজত নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে কেউবা সমঝোতাবিষয়ক আলোচনার ফল নেতিবাচক হতে পারে বলে মন্তব্য করছেন। এদিকে একের পর এক মামলা এবং সংগঠনের প্রভাবশালী নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলেও আপাতত কোনো কর্মসূচিতে যাবে না হেফাজতে ইসলাম। কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে সংগঠনটির সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে এমন তথ্যই মিলছে। একাধিক সূত্র বলছে, পুুলিশের বিশেষ অভিযানের মধ্যেই সোমবার রাতে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের বাসায় বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে হেফাজতের পক্ষে সংগঠনটির নেতাকর্মী, ছাত্র-জনতা আলেম-ওলামাসহ আটককৃতদের মুক্তি, রমজান মাসে ধরপাকড় ও হয়রানি বন্ধ করা এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়। হেফাজত নেতৃবৃন্দের এসব কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তিনি হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করেন, এসব বিষয় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করবেন। বৈঠকে হেফাজত নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, হেফাজতের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নেই এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন কেন্দ্র করে ২৬ মার্চ হেফাজতের কেন্দ্রীয় কোনো কর্মসূচি ছিল না। ওই দিনের জ্বালাও-পোড়াওয়ের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা জড়িত নন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার জানতে চাইলে হেফাজত মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, সরকার হেফাজতকে এখনই তাদের আস্থায় নিতে পারছে না। এ জন্য সংগঠনটিকে আরও পরখ করে দেখতে চায় যে জন্য সময় প্রয়োজন। সর্বোপরি হেফাজতে ইসলামের বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী। কাজেই হেফাজতের নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থার চলমান নজরদারি আপাতত অব্যাহত

থাকবে। হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকার ধাপে ধাপে কঠোর হয়েছে। এ জন্য সময় নিয়েছে। তেমনভাবেই সময় নিয়ে ধাপে ধাপে নমনীয় হতে চায়। সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনার করে ইতিবাচক মনে হলে গ্রেপ্তার অভিযানের লাগাম টেনে ধরার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে। আবার হেফাজতের যে কোনো ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতায়ও রাখা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, চলমান গ্রেপ্তার অভিযানের মধ্যে হঠাৎ হেফাজত নেতাদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক দুপক্ষের নমনীয় মনোভাবেরই অংশ। সরকার পর্দার আড়ালে আলোচনার পথও খোলা রাখতে চাইছে। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের সবুজ সংকেত নিয়েই হেফাজত নেতাদের তাই সাক্ষাৎ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও অপ্রকাশ্যে বৈঠক করেছেন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা। বৈঠকে তারা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল নয়; একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানো হেফাজতের কাজ নয়। তাদের এই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানোর জন্য সরকারের একাধিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছেন হেফাজতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। এরই ধারাবাহিকতায় গত সোমবার দুপুরে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে হেফাজতের পাঁচ শীর্ষ নেতা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদি। বৈঠকে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার বন্ধ করার কথাও বলা হচ্ছে হেফাজতের পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেফাজতে ইসলামের একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদির নেতৃত্বে তিন সহকারী মহাসচিব ও একজন নায়েবে আমির ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তারা হেফাজতের নির্দোষ ব্যক্তিদের মুক্তি, বয়স্কদের হয়রানি না করা, পুলিশের গুলিতে নিহতদের ক্ষতিপূরণ, কওমি মাদ্রাসা খুলে দেওয়াসহ কয়েকটি দাবি জানান।

হেফাজতের ওই নেতা আরও বলেন, সরকার হেফাজতকে বিরোধী দল মনে করে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। যেভাবে হেফাজতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে পারে। এ ছাড়া হেফাজতের অরাজনৈতিক আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে গিয়ে পরিস্থিতি খারাপ করার চেষ্টা করছে। সরকারকে আমরা এ বার্তাটিই দিতে চেয়েছি।

হেফাজতের একজন মধ্যম সারির নেতা বলেন, সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব ও ঢাকা মহনগরের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হকের বিষয়ে সরকার সুযোগ নিয়েছে। তার ব্যক্তিগত বিষয়টিকে সামনে এনে হেফাজতকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা কখনই সরকার উৎখাতের চেষ্টা করিনি। সাংগঠনিক মতাদর্শের ভিত্তিতে আমরা আন্দোলন করে আসছিলাম। ওই নেতা আরও বলেন, এখন যেভাবে হেফাজতের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তারি অভিযান শুরু করেছে, তাতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা না করে উপায় নেই। এ জন্য শীর্ষ নেতারা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। হেফাজত আপাতত আর কোনো কর্মসূচি দেবে না এই শর্তে সমঝোতার চেষ্টা চলছে।

২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম ছাড়াও দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় মোদিবিরোধী কর্মসূচিতে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী সেই ঘটনা টেনে এনে গত সোমবার রাতে এক ভিডিওবার্তায় বলেন, এসব ঘটনা হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা করেনি। এর পরও এ জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, এটিও হেফাজতের নমনীয় মনোভাবেরই বহির্প্রকাশ।

সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে গোপন তথ্য রয়েছে- মোদিবিরোধী কর্মসূচিতে ব্যাপক সহিংসতায় একাধিক শক্তি পেছন থেকে হেফাজতে ইসলামকে ইন্ধন দিয়েছে। এর সঙ্গে বিদেশি শক্তিও যুক্ত। অন্যদিকে হেফাজতকে সামনে ঠেলে দিয়ে সরকারবিরোধী একাধিক পক্ষ ফায়দা লুটতে চায়। অন্যদিকে সরকারও গত প্রায় ১০ দিন ধরে হেফাজতের নেতাদের একের পর এক গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে কঠোর অবস্থানের বার্তাই জানিয়ে দিচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *