রাতে ঠাণ্ডা, ভোরে কুয়াশা আর দিনের বেলায় গরম আবহাওয়ার বিরূপ পরিবেশের কারণে চলতি মৌসুমের ফসলের রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় কয়েক মিনিটের গরম বাতাসে বিস্তীর্ণ জমির বোরো ধানের শীষ চিটায় পরিণত হওয়ার পর ময়মনসিংহের গৌরীপুরে এখন বোরোধানে নতুন করে ব্লাস্ট বা গলাপচা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। কৃষিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করেও কোনো ফল পাচ্ছেন না চাষিরা। এ রোগ এক ক্ষেত থেকে আরেক ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ায় চাষিরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা ‘ব্যাকটেরিয়া লিফ ব্রাইট’ (বিএলবি) বা পাতাপোড়া ও ‘ব্লাস্ট’ বা ছত্রাক প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন চাষিদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী চলতি মৌসুমে ময়মনসিংহ জেলায় দুই লাখ ৬১ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে বোরোধানের আবাদ করা হয়। এতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় ৭ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিকটন। কিন্তু বোরোধানের বাম্পার ফলনের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে দেয় গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় হঠাৎ বয়ে যাওয়া গরম বাতাস বা হিটশক। এতে জেলার চার হাজার ২০১ হেক্টর জমির বোরোধান আক্রান্ত হলেও দুই হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির ধানের শীষ সম্পূর্ণ চিটায় পরিণত হয় এবং ৬৩ হাজার ৩৩৮ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বোরো ফসলের এমন অবস্থা দেখে চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। সেই রেশ কাটতে না কাটতে গৌরীপুর উপজেলার সাতুতি, ইউসুফাবাদ, গাঁওগৌরীপুর, শালীহর, চান্দেরসাটিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় এখন বোরোধানে নতুন করে পাতাপোড়া, ‘গলাপচা’ বা ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত ২-৩ দিনের মধ্যেই রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে এক ক্ষেত থেকে আরেক ক্ষেতে। কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। এ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।
সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে সাতুতি গ্রামের প্রান্তিক চাষি আলম মিয়া তার জমি থেকে গোড়াপচে নষ্ট হওয়া ধানের শীষ তুলে এনে দেখান। অশীতিপর চাষি আবুল হাসেম জানান, দূর থেকে দেখে মনে হয় সোনালি ধানে মাঠ ঝলমল করছে। কিন্তু হাতে নিলে দেখা যায় সব চিটা। কৃষক সোহাগ মিয়া এটা আল্লাহর গজব বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে ক্ষেতের আইল দিয়ে ছুটে আসেন ক্ষুদ্রচাষি ললিতা। তিনি জানান, মাত্র তিন কাঠা জমিতে এবার বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন।
গরম বাতাসে তেমন ক্ষতি না হলেও ‘গলাপচা’ রোগে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি কিছু দেয় তার নামটা যেন থাকে এই অনুরোধ করেন তিনি। চোখের সামনে চারকাঠা জমির বোরোধান ‘গলাপচা’ রোগে বিনষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়ে কৃষক নজরুল বলেন, ‘এবার বোরোধানের বাম্পার ফলনের স্বপ্ন ছিল। দুর্ভাগ্য গরম বাতাসে ধানে চিটা হলো এখন গলাপচা রোগে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ মোহাম্মদ মোস্তফা জানান, রোগাক্রান্ত হওয়ার ২-৩ দিনের মধ্যেই গোড়া পচে ধানের শীষ সাদা হয়ে যাচ্ছে। মজিবুর রহমান তিন একর জমিতে বোরোধানের আবাদ করেছিলেন। এক একর জমির পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান। তিন কাঠা জমিতে পচারোগ দমনে ‘অ্যামিস্টার টপ’ এবং মাইজকাটা প্রতিরোধে ‘ভিরটাকো’ দিয়েছেন খায়রুল মিয়া কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। একই কথা বললেন কৃষক নাজিম উদ্দিনসহ কয়েকজন।
গৌরীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানান, গত ৪ এপ্রিলের গরম বাতাসে গৌরীপুরে আবাদকৃত ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির মধ্যে ১৬০ হেক্টর জমির বোরোধান ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রান্তিক চাষিরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরবর্তী সময়ে দেখা যাচ্ছে কিছু এলাকায় ‘ব্যাকটেরিয়া লিফ ব্রাইট (বিএলবি) বা পাতাপোড়া রোগ এবং ব্লাস্ট (স্থানীয় ভাষায় গলাপচা) রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। অতীতেও দেখা গেছে ঝড়ে যখন ধান ক্ষতিগ্রস্ত তখন কিছু কিছু রোগের আক্রমণও বেড়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা চাষিদের দ্রুত ওষুধ প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। বিএলবি প্রতিরোধে ‘পেট্্েরাবান’ এবং ব্লাস্টের জন্য ‘নাটিভো’সহ অনুমোদিত ওষুধ স্প্রে করতে বলা হচ্ছে। মূলত এখনকার আবহাওয়া ফসলের নানা রোগের জন্য অনুকূল অবস্থায় রয়েছে বলে চাষিদেরকে এসব ওষুধ প্রয়োগে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। রাতে ঠাণ্ডা, ভোরে কুয়াশা আর দিনের বেলায় গরম আবহাওয়ার বিরূপ পরিবেশের কারণে চলতি মৌসুমে ফসলের রোগবালাই দেখা দিয়েছে বলেও মনে করেন কর্মকর্তারা।
হালুয়াঘাট সংবাদদাতা মুহাম্মদ মাসুদ রানা জানান, সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার কয়েকটি এলাকায় ধানের ছত্রাকজনিত রোগ ব্লাস্টের সংক্রমণ দেখা দেয়ায় আধা পাকা ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে এবং ধানগাছের গোড়ায় পচন ধরছে। এ রোগ ছড়িয়ে পড়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা। ব্লাস্ট রোগ দ্রুত ছড়ায় এবং যেখানেই অনুকূল পরিবেশ পায় সেখানেই ছড়িয়ে পড়ে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে হালুয়াঘাটে ১৯ হাজার ৯৬৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে এবং চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ হাজার ২৩৬ মেট্রিক টন। বোরোধানের আবাদ হয়েছে ২২ হাজার ১৪০ হেক্টর। তবে ব্লাস্টের কারণে ব্রি-২৮ জাতের ধান বেশি নষ্ট হওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার ব্যাহত হতে পারে। উপজেলা কৃষি অফিসার মো: মাসুদুর রহমান জানান, দিনে গরম আর রাতে ঠাণ্ডার কারণে ব্লাস্টের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। তিনি কৃষকদের ছত্রাকনাশক ওষুধ ন্যাটিভো-৭৫ ডব্লিউ জি স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছেন।