করোনা পরিস্থিতি দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীনতার দিকে যাচ্ছে। সাধারণদের সাথে চিকিৎসক, নার্স ও অন্য চিকিৎসা কর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে এখন আর সিট পাওয়া যাচ্ছে না। আইসিইউ শয্যা হয়ে গেছে সোনার হরিণ। গতকাল রোববার সার্জারির একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, গতকালই সোসাইটি অব সার্জনসের ওয়েবসাইটে ১৭ জন সার্জন করোনা পজিটিভ হয়েছেন বলে তথ্য শেয়ার করা হয়েছে। অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসকদের একই অবস্থা। নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো চিকিৎসকের মৃত্যু হচ্ছে। বাংলাদেশে মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, গতকাল ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সাতজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে বলে তারা তালিকাভুক্ত করেছে। এই পর্যন্ত ডেন্টালের তিনজনসহ ১৪১ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে করোনা আক্রান্ত হয়ে। চিকিৎসকরা সাধারণের উদ্দেশে বলছেন, দয়া করে এ সময়ে ঘরে থাকুন, অকারণে বাইরে ঘুরে নিজের ও আপনজনদের বিপদ ডেকে আনবেন না। ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারছেন তাদের পরিবারে কী ধরনের বিপদ নেমে এসেছে। মাস্ক না পরে বাইরে বের হবেন না। ঘনঘন হাত ধুয়ে নিন।
এ দিকে ১ এপ্রিল থেকে করোনার সংক্রমণ থেকে ছয় হাজারের ঘর অতিক্রম করেছে, তা আর নামেনি। কেবল গতকাল ছিল ব্যতিক্রম ছাড়া। গতকাল রোববার ছয় হাজারের ঘরের নিচে আক্রান্তের সংখ্যা। চিকিৎসকরা বলছেন, এটি সাময়িক, কালই (আজ সোমবার) হয়তো আবারো সাত হাজারের ঘর অতিক্রম করে যেতে পারে। তবে গতকাল মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়েছে। ৭৮ জন মারা গেছেন করোনা সংক্রমণে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শ্বাসকষ্টের রোগী আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। এটি এখন পরিষ্কার যে পুরো দেশে ইউকে ও দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) ছড়িয়ে পড়েছে; যে কারণে এখন হাসপাতালগুলো ভরে গেছে করোনা আক্রান্ত রোগীতে। গতকাল অন্যান্য দিনের চেয়ে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও মৃত্যুতে আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল সারা দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ৮১৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৭৮ জনের। সারা দেশে ২৯ হাজার ৩৭৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয় এবং করোনা শনাক্তের হার ছিল ১৯.৮১ শতাংশ।
২৪ ঘণ্টায় ৭৮ জনের মৃত্যু নিয়ে করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৯ হাজার ৭৩৯ জনে। আর মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৬ জনে।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতদের মধ্যে ৫৩ জন পুরুষ ও ২৫ জন নারী। তাদের মধ্যে ৭৭ জন হাসপাতালে ও বাসায় অবস্থানকালে একজনের মৃত্যু হয়। একই সময়ে সারা দেশে মোট ২৯ হাজার ২৯৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে পরীক্ষা করা হয় ২৯ হাজার ৩৭৬টি নমুনা। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ১৯ দশমিক শূন্য ৮১ শতাংশ। ২০২০ সালের বছরের ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্তের পর থেকে এ পর্যন্ত শনাক্তের মোট হার ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
একই সময়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন চার হাজার ২১২ জন। এ নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯০ জনে দাঁড়াল। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থতার হার ৮৪ দশমিক ২০ শতাংশ। এক দিনে করোনায় মৃতদের মধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী একজন, ত্রিশোর্ধ্ব ছয়জন, চল্লিশোর্ধ্ব সাতজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব ১৬ জন ও ষাটোর্ধ্ব ৪৮ জন রয়েছেন।
বিভাগওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মৃত ৭৮ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪৭ জন, চট্টগ্রামে ২০ জন, রাজশাহীতে চারজন, খুলনায় চারজন, সিলেটে দু’জন ও রংপুর বিভাগে একজন রয়েছেন। এ দিকে রোগীদের সেবা করতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও চিকিৎসক ও নার্সদের পরবর্তী দিনগুলো কাটছে দুর্বিষহ বিড়ম্বনার মধ্যে। কোভিড ইউনিটে ডিউটি করা প্রতিটি চিকিৎসক ও নার্সকে একনাগাড়ে ৭ দিন টানা ডিউটি করতে হয়। এরপর ৭ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয় এবং আরো ৭ দিন কারো সাথে মিশতে পারে না। এরপর বাসায় যেতে পারেন তারা। অর্থাৎ ২১ দিন পর একজন চিকিৎসক ও নার্স পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারেন। হাসপাতালে ডিউটি করতে গিয়ে তরুণ চিকিৎসক ও নার্সের পারিবারিক অশান্তিও শুরু হয়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। চিকিৎসকদের তার পেশা থেকে ফেরানো সম্ভব না হলেও নার্সদের পেশা ছেড়ে দেয়ার জন্য পারিবারিক চাপ বাড়ছে বলে চিকিৎসক ও নার্সদের অনেকে জানিয়েছেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এখনকার করোনা আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে আসছেন ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ ফুসফুসের ক্ষতি নিয়ে। মুগদা মেডিক্যাল কলেজের একজন চিকিৎসক (নাম প্রকাশ করতে চান না) হাসপাতালে তার অভিজ্ঞতা লিখে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, এখনকার রোগীরা খুব বেশি ফুসফুস ক্ষতি হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন। তাদের বেশির ভাগই অক্সিজেন স্যাচুরেশন (অক্সিজেন সম্পৃক্ততা) ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ নিয়ে আসছেন। মুগদা হাসপাতালে আইসিইউ থেকে অবিরাম কল আসে। ১৪ বেডের আইসিইউ খালি হয় না। অথচ আইসিইউ প্রয়োজন এমন প্রচুর রোগী রয়েছে। স্বজনদের আর্তনাদে হাসপাতালে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চিকিৎসকদের করার কিছু থাকে না।
ওয়ার্ডেই রোগীর স্বজনরা বলছেন, যত টাকা লাগে একটি আইসিইউ বেড দিন। ওয়ার্ডে ১৫ লিটারের বেশি অক্সিজেন দেয়া যায় না। অথচ এমন অনেক রোগীর জন্য প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ৭০ লিটারের অক্সিজেন দরকার। রোগীর স্বজনরা চিৎকার, কান্নাকাটি করেন। কেউ কেউ ক্ষমতাও দেখান। কিন্তু তারা চিকিৎসক, নার্সদের অসহায়ত্ব দেখেন না। দেখার সময়ও নেই। চোখের সামনে অক্সিজেন স্যাচুরেশন নেমে যাচ্ছে পঞ্চাশে। আমরা চিকিৎসক, নার্সরাও অসহায় হয়ে পড়ি। রোগী বাঁচানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে রোগীরা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ওই ডাক্তার বলেন, ২০১৮ সালে ডেঙ্গু মহামারীর সময় একাই ২০০ রোগী সামাল দিয়েছি কিন্তু এতটা অসহায় লাগেনি। তিনি জানান, এক রাতে ৩টার মধ্যে ২২জন রোগী ভর্তি হয়। মুগদা মেডিক্যালের আটতলা থেকে খবর আসে নতুন রোগী ভর্তি করার মতো কোনো সিট নেই। কিন্তু ভোরের দিকে মৃত্যু দেখতে হয়। সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছি।
ওই ডাক্তার বলেন, দু’বার করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর আবারো ডিউটিতে ফিরেছি। অনেক সহকর্মী হারিয়েছে তার আপনজন। টানা ১১ মাসের লড়াইয়ে আমরা বিপর্যস্ত। তিনি সবার উদ্দেশে বলেন, চিকিৎসকদের বকাঝকা বন্ধ করুন, দায়িত্বশীল হন। আইসিইউ বেড বা অক্সিজেন আমরা তৈরি করি না। করোনা আক্রান্ত হওয়ার আগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, অকারণে ঘরের বাইরে যাবেন না, প্রয়োজনে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন। মহামারীর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে চিকিৎসক-নার্সদের সাহায্য করুন।
একজন নার্স বলেছেন, তারা নিজের কথা চিন্তা না করে রোগীর সুস্থতায় খাটছেন কিন্তু তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইনসেনটিভ নেই। অনেক তরুণ নার্সের সংসার ভেঙে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। পরিবার থেকে বলা হচ্ছে চাকরি ছেড়ে দেয়ার জন্য।