চিৎকার করে কেঁদেছি বাবাকে শেষবার দেখতে দেয়নি

Slider বাংলার মুখোমুখি

বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে হাসপাতালের সামনে চিৎকার করে কেঁদেছি। কিন্তু আঞ্জু কাপুরের পাষাণ মনকে গলাতে পারিনি আমরা দু’বোন। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন- প্রয়াত বৈমানিক মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের ছোট মেয়ে মুশফিকা মোস্তফা। স্বামীর মৃত্যুর কথা গোপন রেখে ব্যাংক থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা তুলে নেয়ায় জগলুলের মেয়ের করা মামলায় অভিযুক্ত আঞ্জু কাপুরকে গত মঙ্গলবার সকালে গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

প্রায় ৬ বছর আগে প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদের ভাই জগলুল ওয়াহিদকে দেখাশোনার জন্য ভারতীয় নাগরিক আঞ্জু কাপুর ঢাকায় আসেন। গুলশানের বাসায় থেকে জগলুল ওয়াহিদের সেবা করতেন তিনি। এক পর্যায়ে জগলুল ওয়াহিদ তাকে বিয়ে করেন বলে দাবি করেন আঞ্জু।
গত বছরের ১০ই অক্টোবর জগলুল ওয়াহিদ মারা গেলে জগলুলের আত্মীয়-স্বজনকে না জানিয়েই তার লাশ দাফন করা হয়। অভিযোগ করা হচ্ছে, কাউকে না জানিয়ে বাড়িসহ ব্যাংকে জমা থাকা টাকাও তুলে নেন আঞ্জু।

জগলুল ওয়াহিদের মেয়ে মুশফিকা মোস্তফা মানবজমিনকে বলেন, আঞ্জু কাপুর শুরু থেকেই আমাদেরকে বাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। পৈত্রিক নিবাস থেকে বিতাড়িত করেছেন। তিনি গুলশান-২ এর ৯৫ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়িটিতে আসার পর থেকে আমাদের বাসায় প্রবেশ করতে দেননি। বাবার সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে দেননি। মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের মৃত্যু সম্পর্কে তার ছোট মেয়ে মুশফিকা মোস্তফা বলেন, আমরা মনে করি বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। এই মৃত্যুর পিছনে রহস্য আছে। আমরা এটির সুষ্ঠু তদন্ত এবং সুষ্ঠু বিচার চাই।

প্রয়াত বৈমানিকের এই মেয়ে জানান, বাসার গ্যাস বিল, ওয়াসার বিল সব মিলিয়ে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মতো বাকি রেখেছেন আঞ্জু কাপুর। মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের ক্রেডিট কার্ড যৌথভাবে ব্যবহার করেছেন। সেখানে প্রায় চার লাখ টাকার মতো ডিও রয়েছে। দাফন-কবরের ১১ লাখ টাকাসহ সব মিলিয়ে প্রায় ১৯ লাখ টাকার বিল বাকি রেখেছেন আঞ্জু।

কবরের টাকা পরিশোধ করতে চেয়েছিলেন মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের সন্তানরা। কিন্তু আঞ্জু তাদের ধমক দিয়ে বলেছেন, এ বিষয়ে তোমাদের নাক না গলালেও চলবে। তোমার বাবার কবরের টাকা আমি দেবো। কিন্তু এখনো তা তিনি পরিশোধ করেননি।

মুশফিকা মোস্তফা জানান, মালয়েশিয়াতে মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের সেকেন্ড হোম ছিল। কয়েক কোটি টাকার সেই বাড়িটিও আত্মসাৎ করেছেন আঞ্জু। এমনকি গুলশানের দ্বিতীয় তলার ঘরটিতে মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের সন্তানদের উঠতে দেয়া হচ্ছে না। মুশফিকা মোস্তফা বলেন, আব্বা যে সকল এক্সক্লুসিভ জিনিসপত্র ব্যবহার করতেন এবং দ্বিতীয় তলার যে ঘরটিতে থাকতেন সেখানে এখন পর্যন্ত আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। ওই ঘরে এখন আঞ্জু কাপুরের দুই মেয়ে, নাতি-নাতনি এবং ভাই থাকেন। কিন্তু তাদের তো এখানে থাকার কোনো অধিকার নেই। সন্তান হিসেবে আমাদের যে অধিকার তার প্রত্যেক ক্ষেত্রে আঞ্জু আমাদের বঞ্চিত করেছেন। মুশফিকা বলেন, গুলশানে ১০ কাঠা জমির ওপর আব্বার নির্মিত তিন তলা ভবনটির তৃতীয় তলায় আমি একা থাকি। দ্বিতীয় তলায় আঞ্জু কাপুরের স্বজনরা থাকেন। আমরা কেউ কারো সঙ্গে কথা বলি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাইলেও তারা এড়িয়ে যান। কথা বলেন না।

এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের ভিত্তিতে আঞ্জু কাপুরকে তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। তিনি জানান, মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের ব্যাংক হিসাব পরিচালনার জন্য স্ত্রী আঞ্জু কাপুরকে ম্যান্ডেট দেয়া হয়। বিভিন্ন সময় তিনি তার ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করতেন। বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যাংক থেকে কীভাবে উঠানো হলো, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কেউ জড়িত রয়েছে কি-না এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে সিআইডি।
বৈমানিক মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের সন্তানদের আইনি সহায়তা দিচ্ছেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, হাইকোর্টের সুয়োমোটো অর্ডারের পরে তারা উভয়পক্ষ ওই বাড়িতেই আছেন। এবং আদালতের নির্দেশ অনুসারে বাড়িটিতে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের প্রবেশের ব্যাপারেও কোনো বাধা নেই। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য বর্তমানে পুলিশি প্রহরা রয়েছে। তবে অভিযোগকারিণীর দ্বিতীয় মা দাবি করা আঞ্জু কাপুরের বিরুদ্ধে প্রয়াত জগলুল ওয়াহিদ মারা যাওয়ার পরে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বলে যে চেক দেয়া হয় সেটা দিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন, এই বিষয়ে প্রতারণার মামলা হয়েছে। আদালতে মূলত দু’টি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন এসেছে যে, তাদের বিয়েটি বৈধ কিনা? উইলটি বৈধ কিনা?

গত অক্টোবরে বাবার খোঁজ না পেয়ে ওয়াহিদের দুই মেয়ে মোবাশশারা ও মুশফিকা গুলশানের ওই বাসায় যান। কিন্তু তাদের কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ওই সময়ে আঞ্জু নিজেকে ওয়াহিদের স্ত্রী দাবি করে বলেন, ওয়াহিদ তার স্বামী ছিলেন। তার স্বামী তাকে বাড়িটি লিখে দিয়ে গেছেন। যদিও তার বক্তব্যের সমর্থনে কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে গুলশান থানা পুলিশের হস্তক্ষেপ কামনা করেন মোবাশশারা-মুশফিকা। উভয়পক্ষই গুলশান থানায় দু’টি জিডি করেন। পরে গত ২রা নভেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতপ্রণোদিত হয়ে ২৬শে অক্টোবর সন্ধ্যায় এক আদেশ দেন। আদেশে মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের গুলশান ২-এর ৯৫ নম্বর সড়কের বাসায় তার দুই মেয়ের প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন আদালত। ওই সময় ওয়াহিদের বড় মেয়ে মোবাশশারা সাংবাদিকদের বলেন, ২০০৪ সালে বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ২০০৫ সালে মায়ের সঙ্গে আমার বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। ২০১৪ সালে আমরা দুই বোন দেশের বাইরে ছিলাম। এ সময় আমার বাবা টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। তখন তাকে দেখাশোনার জন্য আঞ্জু কাপুর এ বাড়িতে আসেন। এরপর থেকে তিনি বাবাকে দেখাশোনার জন্য বাবার সঙ্গে এই বাড়িতেই থাকছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে তার স্ত্রী দাবি করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *