একজন ওসির ব্যক্তিগত অপারগতার দায় কি পুরো রাষ্ট্রের!

Slider টপ নিউজ


গাজীপুর: তিন এতিম শিশু সন্তান সহ একজন বিধবা নারীর পরিবারে নিরাপত্তা আশংকা দেখা দিলে পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার দায় একজন ওসির হলে রাষ্ট্র কি সেই দায় নিতে বাধ্য হবে! এই প্রশ্ন তৈরী হয়েছে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার ওসিকে ঘিরে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌর এলাকার মাওনা ওভারব্রীজের পশ্চিম পাশে সদ্য প্রয়াত মেয়র প্রার্থী শহিদুল্লাহ শহিদের পরিবার নিরাপত্তা আতঙ্কে পড়ে যায়। শহিদের ভাইয়েরা মরহুম শহিদুল্লাহর সম্পত্তি দখল করে তিন এতিম শিশু সন্তান ও শহিদুল্লাহর স্ত্রীকে নিজ বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখেন বলে শহিদুল্লাহর স্ত্রীর অভিযোগ। গত ২৬ জানুয়ারী এই ঘটনা ঘটে।

পারিবারিকভাবে মুক্ত হতে না পেরে শহিদুল্লাহ স্ত্রী তার স্বাক্ষরিত একটি সাধারণ ডায়েরীর আবেদন শ্রীপুর মডেল থানায় পাঠিয়ে নিরাপত্তা চান। থানায় ওসি না থাকায় পরিদর্শক তদন্ত তাৎক্ষনিকভাবে একজন এসআইকে( এস আই সুমন) ঘটনাস্থলে পাঠান। এসআই ঘটনাস্থলে গিয়ে জিডির সততা পান বলে গণমাধ্যমকে জানান।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সুমন ঘটনাস্থলে থাকা অবস্থায় একটি ফোন আসলে সুমন বের হয়ে যান। ফলে অবরুদ্ধ পরিবারকে মুক্ত করতে পারেনি দারোগা সুমন। ঘটনাস্থল থেকে বোরিয়ে সুমন বাদীপক্ষকে ওসির সাথে কথা বলতে বলেন। গভীর রাত হওয়ায় শহুিদু্ল্লাহর শশুর শেখ আব্দুর রাজ্জাক পরদিন বিকেলে ওসির কাছে গেলে ওসি প্রতিপক্ষ এসেছিল বলে রাজ্জাককে জানিয়ে ঘটনা আপোষ করে দিবেন বলে জানান। এই সময় একজন সংবাদকর্মী জিডি গ্রহন করা হবে কি না জানতে চাইলে ওসি তার উপর চড়াও হন। ফলে ভিকটিমের আবেদন জিডি, অভিযোগ বা মামলা কোনরুপেই রেকর্ড হয়নি।

এদিকে বিষয়টি গণমাধ্যমে ফলাওভাবে প্রচারিত হলে এসআই সুমন দ্বিতীয়বারের মত ঘটনাস্থলে যায় এবং ৭ টির মধ্যে একটি তালা খুলে দেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারী দুপুরে ওসির পরামর্শে পারিবারিকভাবে বসে বিষয়টি নিস্পত্তি করার খসড়া তৈরী হয়। ওই দিনই সন্ধ্যায় ওসি সিভিল পোষাকে ভিকটিমের সাথে দেখা করে আপোষের বিষয় সম্পর্কে জানতে চান। পরদিন প্রতিপক্ষ একটি আপোষনামা তৈরী করে ভিকটিমের স্বাক্ষর নিতে যায়। স্বামীর সম্পদ ও তার পরিবারের নিরাপত্তার লিখিত নিশ্চয়তা না পেয়ে ভিকটিম আপোষ নামায় স্বক্ষর করেননি। আর প্রতিপক্ষ নানা কৌশলে আপোষ নামায় ভিকটিমের স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করছেন।

ঘটনার খবর পেয়ে স্থানীয় সাংসদ ইকবাল হোসেন সবুজ ভিকটিমের সাথে কথা বলে ১১ফেব্রুয়ারী বসে সমস্যা সমাধান করে দিবেন বলে আশ্বাস দেন।

শ্রীপুর থানার একটি গোপন সূত্র জানায়, কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত শ্রীপুর পৌর নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী হিসাবে শাহ আলম নির্বাচন করেন। নির্বাচনের দিন ভ্রাম্যমান আদালতের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগের ঘটনায় শাহ আলম থানায় আটক হয়। পুলিশ কিছুক্ষন পর তাকে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে শাহ আলমের সাথে ওসির একটি ব্যাক্তিগত সখ্যতা গড়ে উঠে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, একজন নাগরিক নিরাপত্তা চেয়ে জিডি নিয়ে গেলে পুলিশ জিডি নিতে বাধ্য। কিন্তু জিডি, অভিযোগ বা মামলা কিছুই না নিয়ে নিরাপত্তা অনিশ্চিত করে আপোষের জন্য চাপ তৈরী করা একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাজ নয়। এছাড়াও প্রতিপক্ষ বিএনপির লোক থাকায় রাজনৈতিক ঝামেলাও ছিল না। তাহলে কেন ওসি সাহেব এমনটি করলেন তা বোধগম্য নয়। তবে একজন ওসির ব্যর্থতার দায় পুরো রাষ্ট্র বহন করবে এমনটি নেই।

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ বাধ্য। কোন কর্মকর্তা অবহেলা করে থাকলে তার দায় নিজের,রাষ্ট্রর নয়।

প্রসঙ্গত: গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌরসভার প্রয়াত মেয়র প্রার্থী শহিদুল্লাহ শহিদের স্ত্রী তিন সন্তান সহ ৯দিন ধরে নিজ বাসায় অবরুদ্ধ থাকেন। ৮ম দিনে অরুদ্ধ থাকা অবস্থায় বাসার গেট ভেঙ্গে একটি কক্ষ তছনছ করা হয়েছে। এই বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়ায় এতিম পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন প্রয়াত শহীদের স্ত্রী।

বুধবার( ৩ ফেব্রুয়ারী) ভিকটিম জানান,প্রতিপক্ষ শাহ আলম লোকজন নিয়ে তার বাসায় যাতায়াতের একমাত্র পকেট গেট ভেঙ্গে নিয়ে গেছেন। এ সময় তারা শহিদের বাসায় প্রবেশ করে একটি রুম থেকেও জিনিসপত্র নিয়ে যায়।

খবর পেয়ে এস আই সুমন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বাসাটি মুক্ত করতে পারেনি।

এর আগে মঙ্গলবার(২ ফ্রেব্রুয়ারী) রাতে শহিদের স্ত্রী শাহীন সুলতানা সুইটি গণমাধ্যমকে এই খবর নিশ্চিত করেন। গত কয়েকদি ধরে এই বিষয়ে মিডিযা পাড়ায় নানা গুঞ্জন চলে আসছিল।

সুইটি জানান, তার স্বামী শহিদুল্লাহ শহিদ শ্রীপুর পৌরসভায় মেয়র পদে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে দুইবার নির্বাচন করলেও শেষবার নির্বাচনের মাঝপথে মারা যান। এতে নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর পুনরায়র তপসিল হয়ে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এই নির্বাচনে শহীদের ভাই শাহ আলম ধানের শীষের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে পরাজিত হন। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৫দিন মৃত্যুও সঙ্গে যুদ্ধ করে তার স্বামী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান।

সুইটির ভাষ্যমতে, তার স্বামীর যাবতীয় চিকিৎসা স্বামীর ভাই শাহ আলম, মোস্তফা কামাল ও শহিদের ভগ্নিপতি হারুনর রশিদ সম্পন্ন করেন। স্বামীর চিকিৎসার কথা বলে চেকের মাধ্যমে ২০ লাখ ও নগদ ৫ লাখ সহ ২৫ লাখ টাকা নেয় তারা। কিন্তু চিকিৎসার বিষয়ে সুইটিকে আড়ালে রাখেন ওই তিনজন। পরবর্তি সময় স্বামীর মৃত্যু নিয়ে নানা ধরণের প্রশ্ন তৈরী হলে সুইটিকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেন ওই তিন ব্য্যক্তি। এক পর্যায়ে ২৬ জানুয়ারী রাতে শাহ আলম সুইটির বাসার চারিদিকে তালা লাগিয়ে দেয়। সকাল বেলা একটি পকেট গেট খোলা থাকায় সুইটি বাইরে এসে দেখেন ৭টি গেটে তালা লাগানো। নিরাপত্তাকর্মীর কাছ থেকে সুইটি জানতে পারেন শাহ আলম তালা মেরে চাবি নিয়ে গেছেন। পরবর্তি সময় শাহ আলম শহিদের বাসায় অবস্থানরত শহিদের স্ত্রী ও সন্তানদের নজরবন্ধি করতে সিসি টিভির নিয়ন্ত্রনও নিয়ে নেয়।

সুইইটি আরো জানান, তার স্বামীর মৃত্যুর পর শাহ আলমগং তার স্বামীর সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জোর করে দখল করেন। সকল উপার্জন বন্ধ ও নজরবন্ধী থাকায় সুইটি তিন সন্তান সহ নিজ বাসায় আটকা পড়ে যায়। পারিবারিকভাবে এই ঘটনার কারণ জানতে ব্যর্থ হয়ে সুইট স্বাক্ষরিত একটি সাধারণ ডায়েরী তার বাবা শেখ আব্দুর রাজ্জাকের মাধ্যমে ৩০ জানুয়ারী শ্রীপুর মডেল থানায় পাঠান। ওই রাতেই শ্রীপুর থানার এসআই সুমন সুইটির বাসায় আসেন এবং ঘটনা তদন্ত করেন। পরদিন ৩১ জানুয়ারী সুইটির বাবা শেখ আব্দুর রাজ্জাক শ্রীপুর থানার ওসির সাথে দেখা করলে ওসি, শাহ আলম গং এসেছিল বলে জানিয়ে বিষয়টি আপোষ করবেন বলে রাজ্জাককে জানিয়ে দেন।

এদিকে সুইটি যেন বাইরে যোগাযোগ করতে না পারেন সেজন্য সোমবার রাতে শাহ আলমগং সুইটির বাসার ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেন।

সুইটির দাবী, শাহ আলমগং তাকে ও তার তিন সন্তানকে তার স্বামীর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য যে কোন সময় হত্যা করতে পারেন। অথবা তাদেরকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করতে পারেন। বর্তমানে সুইটি তিন সন্তানসহ চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন দাবী করে সরকারের নিকট নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহবান জানান।

ঘটনার পর পুলিশের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য:

শ্রীপুর থানার ওসি ইমাম হোসেন জানান, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে পুলিশ সুুইটির বাসায় যায়নি, আসামীদের বাসায় গিয়েছেন বলে জানান ওসি। সুইটি সন্তানসহ অবরুদ্ধ কি না তিনি জানেন না।

এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুমন জানান, একটি জিডির আবেদনের প্রেক্ষিতে তিনি শহিদের বাসায় গিয়েছেন। সুুইটির সাথে কথা বলেছেন। সকল গেট বন্ধ ও একটি পকেট গেট খোলা থাকার কথা স্বীকার করলেও সুমন জানান, পরবর্তি সময় বাদী পক্ষ তার কাছে আসেননি। অথচ সুমনের কথামত বাদীর বাবা ওসির সাথে সাক্ষাত করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *