তৃতীয় ধাপের পৌর নির্বাচন ভোটারের কব্জি কর্তন, ব্যালট ছিনতাই, গুলি, বর্জন

Slider সারাদেশ

অনিয়ম, সংঘাত ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী তৃতীয় ধাপের পৌর নির্বাচন শেষ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে গোলাগুলি, এজেন্টকে মারধর এমনকি ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে কোথাও ভোটারের হাতের কব্জি ও আঙ্গুল কেটে ফেলার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, ভোটের সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সংবাদকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বাধার মুখে পড়েছেন এবং লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনিয়মের অভিযোগ এনে অনেক স্থানে বিরোধী দলীয় মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট বর্জন করার খবরও পাওয়া গেছে।

ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর পৌর নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ১০ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে সোমেলা বেগম নামে এক নারীসহ দুইজনের কব্জি ও দুইজনের হাতের আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
গতকাল বেলা সোয়া ১১টার দিকে পৌরসভার কুতুবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে এ হামলার ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, ভূঞাপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী পানির বোতল প্রতীকের আনোয়ার হোসেন সমর্থিতরা জাল ভোট দেয়া শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী উটপাখি প্রতীকের জাহিদুল ইসলামের সমর্থকরা প্রতিবাদ করেন।
এক পর্যায়ে জাহিদুলের এজেন্টসহ সমর্থকদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হলে আনোয়ার গ্রুপের লোকজন জাহিদুল ইসলামের সমর্থকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে শুরু করে। এতে জাহিদুলের পক্ষের নারীসহ ১০ জন আহত হন।

এদের মধ্যে সোমেলা বেগমসহ দুইজনের হাতের কব্জি ও দুইজনের আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এদিকে ওই কেন্দ্রে সাময়িকভাবে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্র এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। ১ নম্বর ওয়ার্ডে দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসার শাহীনুল ইসলাম বলেন, দুই কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ৩০-৩৫ মিনিট ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়।

রামগঞ্জ (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি: লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম কাজিরখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। গতকাল সকাল ১১টার দিকে ভোট চালাকালীন সময়ে এই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে জেলা পুলিশ সুপার ড. এএইচএম কামরুজ্জামান ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রিয়াজুল কবিরসহ অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। কাউন্সিলর প্রার্থী আনোয়ার হোসেন জিতুর ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মামুনুর রশিদ।

কেন্দ্রটিতে উপস্থিত দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আখতার জাহান সাথী জানান, রামগঞ্জে ১৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ৯টিই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিম কাজীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রও ছিল। আহতদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক আহতদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। সংঘর্ষ এড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে।

ফেনী প্রতিনিধি জানান, ফেনী পৌরসভা নির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। শহরের একটি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থী আহত হয়েছেন। পৌরসভার ১৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ডালিম প্রতীকের তাজুল ইসলাম জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পশ্চিম রামপুর সাইদী-মেহেদি পৌর বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশে ৬/৭টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। তিনি কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে চাইলে আওয়ামী লীগ সমর্থীত কাউন্সিলর প্রার্থী উট পাখি মার্কার দিদারুল ইসলাম দিদারের সমর্থকরা তাকে কুপিয়ে আহত করে। তার এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। এ কেন্দ্রের গাজর প্রতীকের নুরুল ইসলাম জানান, রাত থেকেই বহিরাগত সন্ত্রাসীরা কেন্দ্র দখল করে রাখে। সকালে তাকে পিটিয়ে আহত করে। এ কেন্দ্রে ভোটারদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। নারী ভোটারদেরও লাঞ্ছিত করে বহিরাগতরা।

অভিযোগের ব্যাপারে উটপাখি প্রতীকের দিদারুল ইসলাম দিদার বলেন, অভিযোগ অসত্য। ভোটে বিশৃঙ্খলা করার জন্য তারা এসব বলছে। সুষ্ঠু ও সুন্দর ভোটগ্রহণ চলছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা সহকারী পুলিশ সুপার সদর সার্কেল আতোয়ার রহমান বলেন, হামলার ব্যাপারে পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি।

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ থেকে জানান, ময়মনসিংহের গৌরীপুরে পৌরসভা নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগে দুই চেয়ারম্যানসহ ৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে গৌরীপুর সরকারি কলেজ কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। আটকরা হলেন- রামগোপালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আলামিন জনি, অচিন্তপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম শহিদ, ছাত্রলীগ নেতা কাউসার মিয়া ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান দুলাল আহমেদ। বিষয়টি নিশ্চিত করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাইদুল ইসলাম বলেন, ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের সময় ৩ চেয়ারম্যানসহ ৪ জনকে আটক করা হয়।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টদের মারপিট করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেয়াসহ নানা অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেছেন বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী শরিফুজ্জামান তুহিন। গতকাল সকাল ১০টায় নিজ নির্বাচনী কার্যালয়ে এই ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি। বিএনপি’র এই প্রার্থী বলেন, এই সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ভোট হতে পারে না। আমি প্রার্থী অথচ আমাকে মারপিট করে কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রের এজেন্টদেরও মারপিট করে বের করে দিয়েছে। সাংবাদিকদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। প্রহসনের এক নির্বাচন হচ্ছে। সকাল ৯টার আগেই প্রতিটি কেন্দ্রের ব্যালটে সিল মারা শেষ করে ফেলেছে। পৌরসভার ভোটার নয় এমন নারী-পুরুষদের এনে ভোটকেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ভেতরে প্রিজাইডিং অফিসারের সহযোগিতায় পুলিশ ভোট কেটে বাক্স ভরছে। কোনো আইনি সহায়তা পাইনি আমি।
এদিকে পৌরসভার গোপিনাথপুর ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের ছবি ও ভিডিও নিতে বাধা দিয়েছেন কেন্দ্রটির দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির। ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি’র ক্যামেরাপারসন পলাশকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

গণমাধ্যমকর্মী পলাশ বলেন, কেন্দ্রের ভিডিও নিতে গেলে পুলিশ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বাধা দেন। গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। ঘটনাটি পুলিশ সুপারকে জানানো হয়েছে। এদিকে ঝিকরা প্রি-ক্যাডেট কেন্দ্রে পরিচয়পত্র ও পরিদর্শনপত্র দেখানোর পরও দৈনিক মানবজমিনের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ইয়াবর হোসেনসহ স্থানীয় সংবাদকর্মীদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছেন কেন্দ্রটির দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম।

এ বিষয়ে গোপিনাথপুর কেন্দ্রে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট ইন্দ্রজিত সাহা বলেন, কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী পৌরসভা নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, ধানের শীষের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে বিএনপি প্রার্থী মো. তোফাজ্জল হোসেন খান দিলীপ নির্বাচন বর্জন করেছেন। গতকাল সকাল ১১টায় তার নির্বাচনী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।

তিনি জানান, সকাল থেকেই ভোটারদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভোটারদের হাত থেকে মেয়র পদের ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে জোরপূর্বক নৌকা প্রতীকে সিল মারার অভিযোগ করেন। এ নিয়ে কেন্দ্রে কেন্দ্রে এজেন্টদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় এবং প্রশাসনের কাছে প্রতিকার চেয়ে কোনো প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগ ওঠে।

এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মিসেস সালমা আনিকা কেন্দ্র থেকে তার নির্বাচনী এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেয়া, জোরপূর্বক ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে সাকাল সোয়া ১১টায় রিটার্নিং অফিসার বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়ে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানান।

বগুড়া ও শিবগঞ্জ প্রতিনিধি: বগুড়ার শিবগঞ্জে এজেন্টদের বের করে দেয়া, সমর্থকদের মারপিট ও কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন বিএনপি সমর্থিত ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মতিয়ার রহমান মতিন। ভোট গ্রহণ শুরুর সাড়ে ৩ ঘন্টার মাথায় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ঘোষণা দেন।

বিএনপি’র এই মেয়র প্রার্থী দাবি করেন, পৌর অঞ্চলের বেড়াবালা, গরীবপুর, দহিলা, শব্দলদিঘীসহ প্রায় সবগুলো কেন্দ্রে সবুজ টুপি পরিহিত আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা ভোটারদের মারপিট করে এজেন্টদের বের করে দিয়ে জাল ভোট দিচ্ছেন। প্রতিটি কেন্দ্রেই সবুজ টুপি পরা আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা কেন্দ্র দখল করে রেখেছে। ৯নং ওয়ার্ডের নাট মরিচাই ভুরঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ধানের শীষের এজেন্ট আব্দুল হামিদকে পুলিশ হুমকি দিয়েছে এবং নৌকার এজেন্ট দেলোয়ার ও তাহেরুল তাকে মারপিট করে ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছে। এ সময় বানাইল বালিকা বিদ্যালয়ে ভোট দিতে গিয়ে ধানের শীষের সমর্থক আশরাফুল ইসলামকে মারপিট করাসহ নানা অভিযোগ করেন তিনি। এদিকে ৯নং ওয়ার্ডের টেবিল ফ্যান প্রতীকের কাউন্সিলর প্রার্থী মোকছেদ আলীও ভোট বর্জন করেছেন। তবে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তৌহিদুর রহমান মানিক সুষ্ঠু ভোটের দাবি করে জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

অপরদিকে নন্দীগ্রাম পৌরসভার মুনসুর আলী ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়ার চেষ্টার অভিযোগে এক অধ্যক্ষকে আটক করেছে পুলিশ। তিনি নন্দীগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ বলে জানা গেছে। মুনসুর হোসেন ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুল কাইয়ুম এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

নাটোর প্রতিনিধি: নাটোরের সিংড়ায় ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তায়জুল ইসলাম। গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন তিনি। তায়জুল ইসলাম অভিযোগ করেন, প্রায় সবক’টি কেন্দ্রে বিএনপি’র এজেন্টদের হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে। কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারছে। প্রশাসনকে জানিয়ে কোনো ফল না পেয়ে আমরা এই নির্বাচন বর্জন করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *