আমাদের নির্বাচন কমিশন বিবেক প্রতিবন্ধী—আবুল মকসুদ

Slider বাংলার মুখোমুখি

নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে ভোটাররা ভোটকেন্দ্র বিমুখ হচ্ছে বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিবেকশূন্য হয়েছেন। তারা ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করছেন। সরকারি কর্মচারীদের সিংহভাগ সরকারদলীয় কর্মীর মতো আচরণ করছেন। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন এখন কল্পনায় পরিণত হয়েছে। ভোটাধিকার হারিয়ে মানুষ এখন রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছে সুশীল সমাজ। গতকাল সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ মতামত দেন।

বৈঠকে অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, গণতন্ত্রের প্রকৃত ধারণার সঙ্গে আমাদের চারিদিকে যে অবস্থা দেখছি তার কোনো মিল নেই। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। এখনকার নির্বাচন যেন সত্তর-আশির দশকের নির্বাচনের মতো হয়ে গিয়েছে। গণতন্ত্র, নির্বাচন এসব বিষয় ক্রমাগত কল্পনার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর হাতে সকল নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। এর মাধ্যমে এক ধরনের সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কে প্রধানমন্ত্রী সেটা কোনো বিষয় না। নির্বাহী বিভাগের এই যে ক্ষমতা তৈরি হয়েছে এটাকে আলোচনা না করে শুধুমাত্র কমিশন নিয়ে আলোচনা করলে আর হবে না। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যেখানে রাজনীতি মানে ফৌজদারি অপরাধ। আবার যারা সরকার দলীয় রাজনীতি করে না তারাও অপরাধী। এই পরিস্থিতিতে মানুষ রাজনীতি বিমুখ হচ্ছে। দেশ বিরোধী মত শূন্য হচ্ছে। পুরোপুরি প্রশাসন ও পুলিশে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে সেখানে তো সরকারি দল সফল হওয়ারই কথা।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনের পিছনের শক্তি হলো আদালত। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত কোনো আদালতকে কমিশনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে দেখিনি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনারগণ একটা আইনের মাধ্যমে নিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। তাই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়ন করে যাতে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সমপন্ন হয় সেদিকে আমাদের জোর দিতে হবে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের প্রধান অংশীদার হলো সরকার। কমিশন গঠনের জন্য যেসব সার্চ কমিটি গঠন করা হয় এগুলোতে সরকার যাকে চায় সেরকম লোকই বেরিয়ে আসে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকেও এটা দেখেছি। তাই সরকার না চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা খুবই দুরূহ।

গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, নির্বাচন, গণতন্ত্র এসব এখন কবি গান, ঘেঁটু গানের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র নেই সেখানে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অনীহা, বিরক্তির কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন বিবেক প্রতিবন্ধী। বুদ্ধি তাদের প্রখর। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি বিবেকশূণ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের বিবেকশূণ্যতার কারণে নির্বাচন নিয়ে জনগণের আগ্রহ শূণ্যের কোটায় গিয়ে ঠেকেছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আগে জানতাম সামরিক শাসকরা বিরাজনীতিকরণ করে, একটা বেসামরিক সরকার যে এভাবে বিরাজনীতিকরণ করতে পারে এখন আমরা তাও দেখতে পাচ্ছি। আমি সবাইকে বলবো সামনে স্থানীয় সরকারের যে নির্বাচনগুলো আছে সেগুলোকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। তিনি আরো বলেন, বুদ্ধি ও বিবেকের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় তখন বুদ্ধি জয়ী হয়। বিবেকের ডাক প্রচ্ছন্ন রেখে বুদ্ধি দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সমস্যাটা হচ্ছে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার ক্ষমতা আছে কিন্তু ফাংশন করছে না। তারা সরকারি দলের অংশ হিসেবে কাজ করছে। তত্ত্ববধায়ক সরকারের সময় ঠিকই কাজ করেছে। কারণ তখন মাঠ প্রশাসন সাজানো থাকলে চেঞ্জ করে দেয়। একমাত্র সমাধান হচ্ছে দলীয় সরকারের পরিবর্তে যেকোনো আদলে হোক নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনে ভয়াবহ কারচুপি হচ্ছে। যে জিতছে সে লাখের ঘরে, অন্যরা শতের ঘরে। এই ভয়াবহ কারচুপি আমরা মেনে নিয়েছি। দু’একটা লোক ছাড়া কারো মাথা ব্যথা নাই। সরকার মানুষকে ভোটকেন্দ্র থেকে হটিয়ে দিয়েছে। ১০ শতাংশ ভোট পড়ে এখন। এই ভোট মাস্তানের ভোট, কারচুপির ভোট।

আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখন যা হচ্ছে এগুলোকে নির্বাচন বলা যায় না। ক্ষমতায় যখন যারা থাকে তারা আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। এই রাজনৈতিক দর্শন পরিবর্তনের জন্য জনগণের দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের একটা রূপরেখা তৈরি করা দরকার বলে আমি মনে করি।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান। তিনি বলেন, আমরা অনেক কথা বলছি। কিন্তু যারা শোনার তারা শুনছেন না, বা শুনলেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাই একটা ব্যাপক গণআন্দোলন সৃষ্টি করা দরকার। তাহলে হয়তো কিছু হতে পারে। এইজন্য আমাদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। প্রবন্ধে বলা হয়- দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সময়ে বহু অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আমাদের নির্বাচন কমিশন ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার, অনেকগুলো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তারা তদন্ত করেছে বলেও আমরা শুনিনি। এটি সুস্পষ্ট যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অসততা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আমাদের অসংখ্য নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ করেছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে তারা ভোট দিতে চাইলেও ভোট দিতে পারবে না। আর ভোট দিলেও তারা ‘ফলাফল’ প্রভাবিত করতে পারবে না- যারা জয়ী হবার তারাই জয়ী হবেন। কেন্দ্রভিত্তিক নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণ থেকে আমরা দেখেছি, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত ফলাফল বহুলাংশে বানোয়াট। তাই এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাই আজ ভেঙে পড়েছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে ফেলেছে। এছাড়াও আমাদের রাজনীতি আজ বহুলাংশে বিরোধী দল শূন্য হয়ে পড়েছে, যার দায় অবশ্য আমাদের প্রধান বিরাধী দলও এড়াতে পারে না। ফলে বহু নাগরিকের মধ্যে আজ চরম অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।

নাগরিকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও হাতাশা-নিরাশার পরিণতি চরম অমঙ্গলকর হতে বাধ্য। এটি অনেককে, বিশেষত তরুণদের বিপদগামী হয়ে বিকল্প ‘সমাধানের’ -ধর্মভিত্তিক সমাধানের দিকে ধাবিত করতে পারে, যার আলামত ইতিমধ্যেই আমরা উগ্রবাদীদের মাঝে-মধ্যে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দেখতে পাই। অন্যদিকে বিরোধী দলহীন রাজনৈতিক অঙ্গনও আমাদেরকে মিশরের পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করতে পারে, যেখানে কর্তৃত্ববাদের অবসানের পর ইসলামিক ব্রাদারহুড শূন্য মাঠে গোল দিতে সক্ষম হয়েছিল, যার আলামতও এখন দৃশ্যমান।

গোলটেবিল বৈঠকে আরো বক্তব্য রাখেন- সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, বিচারপতি এম এ মতিন, সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল, ফটো সাংবাদিক শহীদুল আলম, সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার, সহ-সভাপতি ড. হামিদা হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য সি আর আবরার, একরাম হোসেন, নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দর খান, সফিউদ্দিন আহমেদ, আকবর হোসেন প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *