উত্তরাঞ্চলে তীব্র শীতের পদধ্বনি

Slider জাতীয়

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমানণ ক্রমাগত কমতে থাকা, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসায় রংপুরসহ এই অঞ্চলের ১৬ জেলায় এবার স্বাভাবিক সময়ের পক্ষকাল আগেই শুরু হয়েছে শীত। দেখা দিয়েছে তীব্র শীতের পদধ্বনি। শুক্রবার কুয়াশার কারণে দিনভর সূর্যের দেখা মেলেনি এই অঞ্চলে। সন্ধ্যার পরপরই কুয়াশার চাদরে বন্দী হয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব। এই অবস্থাকে ‘ডেঞ্জার’ উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চলমান আবহাওয়া পরিবর্তন না ঘটলে এবার শীতের তীব্রতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলের পৌনে এক কোটি হতদরিদ্র মানুষের চরম দুর্ভোগের দ্বারপ্রান্তে আছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র জানায়, অগ্রহায়ণের শুরু থেকেই এই অঞ্চলে ক্রমাগতই কাছাকাছি আসছে সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ তাপমাত্রা। কমছে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও। এতে বাড়ছে আর্দ্রতার শতকরা হার। সর্বোচ্চ সর্বনি¤œ তাপমাত্রা কাছাকাছি আসা এবং সন্ধ্যায় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এবার পনেরো দিন আগেই এই অঞ্চলে শীতে এসে গেছে। সাধারণত অগ্রহায়ণের চতুর্থ সপ্তাহের শুরুর দিকে এই অঞ্চলে শীত আসে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া সহকারী আব্দুস সবুর জানান, শুক্রবার রংপুরে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল সন্ধ্যা ৬টায় ১৮ দশমিক ০ এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সন্ধ্যা ৬টায় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল সর্বোচ্চ ৮৪ ও সর্বনি¤œ ৬৩ শতাংশ।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, এবার অগ্রহায়ণের প্রথম দিন থেকেই রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসা শুরু করেছে। ফলে শীত ও কুয়াশাও পড়া শুরু হয়েছে আগে থেকেই। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ক্রমাগত কমার কারণে শীত অনুভবের পাশাপাশি আগাম কুয়াশা পড়াও শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, আবহাওয়ার এই অবস্থার উন্নতি না হলে এবার তীব্রতর শীত পড়বে। যার পদধ্বনি ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। শীতের তীব্রতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা করছেন এই আবহাওয়াবিদ।
সরেজমিন পাওয়া তথ্যমতে, এবার এই অঞ্চলে অগ্রহায়ণের শুরু থেকেই বাড়ছে শীতের তীব্রতা। মাগরিবের নামাজের আগেই বিস্তীর্ণ জনপদে দেখা যায় কুয়াশার চাদর। ফলে এই অঞ্চলের নগর বন্দর, পাড়া মহল্লার আড্ডাস্থলগুলো এখন ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ শীতের গরম কাপড় পরে চলাফেরা শুরু করে দিয়েছেন। বাসাবাড়িতে লেপ, কাঁথা ব্যবহার শুরু হয়েছে। ভোরবেলাতেও কুয়াশার কারণে অনেক পরিবহন হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে।
আগাম উদ্যোগ নেই : সরকারি হিসেবে এই অঞ্চলে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ লাখ। তাদেরকে সরকার ভিজিএফ ভিজিডিসহ নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু এসব অতিদরিদ্র মানুষের শীত নিবারণের জন্য গরম কাপড় কেনার তেমন একটা সামর্থ্য থাকে না। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার দেয়া শীতবস্ত্রই ফি বছর তাদের ভরসা । অন্য দিকে সেন্টার ফর স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিএসডি) নামে একটি সংগঠন তাদের জরিপে বলেছে, উত্তরের ষোলো জেলায় সাড়ে আট হাজার বস্তিসহ প্রায় পৌনে এক কোটি অতিদরিদ্র মানুষের বসবাস। প্রতি বছরই শীতে চরম দুর্ভোগে পড়েন তারা। দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। প্রতি বছরই এই অঞ্চলে শীতের তীব্রতায় প্রাণহানির ঘটনা দেশে বিদেশের প্রেস, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজে স্থান পায়। এবার এই অবস্থা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বলা হলেও সরকারি ও বেসরকারিভাবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত আগাম কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট-ইরি বাংলাদেশের কনসালট্যান্টের ড. এমজি নিয়োগী নয়া দিগন্তকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এবার দুই মাস আগেই শীত এসেছে উত্তরাঞ্চলে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শীতের তীব্রতা বাড়বে বহুগুণ। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতেও পারে। এই অবস্থার স্থায়ী সমাধানে কোনো সরকারই আগাম উদ্যোগ নেয় না। শীতের সময় জোড়াতালি দিয়ে সরকারিভাবে প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য সহযোগিতা করা হয়। তিনি বলেন, এখনই শীত মওসুমকে অগ্রাধিকার দিয়ে উত্তরাঞ্চলের জন্য সরকার পৃথক কার্যকর প্রকল্প না নিলে এই পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ দীর্ঘদিন থেকে অতি দরিদ্র মানুষ, জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীর ওপর গবেষণা করেছেন। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, এবার এই অঞ্চলে আগাম শীত নেমেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে শীত প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানার পর উদ্যোগ নেয়া হয়, তাও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ফলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয় অতি দরিদ্র পরিবারগুলোতে। প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে। এ জন্য তিনি সরকারকে এখনই শীত মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছেন।
উত্তরাঞ্চলের ডিসি অফিস সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলের ডিসি অফিসগুলো শীত মোকাবেলায় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখনো কম্বল কিংবা শীতের কাপড় চেয়ে ওপরে কোনো আবেদন করেননি। জেলাগুলোর ত্রাণকর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছর শীতের মৌসুমে এই অঞ্চলে সরকারিভাবে কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৭২ হাজার। কিন্তু তা দিয়ে শীত মোকাবেলা করতে না পারায় ডেপুটি কমিশনাররা প্রতি জেলায় ৩০ হাজার করে মোট সাড়ে চার লাখ ৮০ হাজার শীত বস্ত্রের চাহিদা দিয়ে দফায় দফায় ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরসহ ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু পরে চাহিদার সামান্যই পাওয়া গিয়েছিল।
রংপুরের জেলা ত্রাণকর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে জানান, ‘চলতি শীত মৌসুমে এখন পর্যন্ত সরকার কোনো বরাদ্দ দেয়নি। আমরাও কোনো চাহিদাপত্র পাঠাইনি। পরিস্থিতি বুঝে তার পর চাহিদাপত্র পাঠানো হবে।’
শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব : রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও উত্তরাঞ্চলের জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে প্রকাশ, আগাম শীত আসায় এসব হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও জেলা ও উপজেলা সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেসরকারি ক্লিনিক এবং লোকালয়ের হাতুড়ে ও পল্লী চিকিৎসকদের চেম্বারেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তদের ৭০ ভাগই নিউমোনিয়া, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং মাথাব্যথার রোগী। এদের মধ্যে আবার ৮০ ভাগই বৃদ্ধ ও শিশু।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নয়া দিগন্তকে জানান, শীত আগাম আসায় এই অঞ্চলে নিউমোনিয়া, জ্বর সর্দি কাশিসহ শীতজনিত রোগের মাত্রা বাড়তে শুরু হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *