ভারতের আতিথেয়তায় মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তার তিন দিনের সফরকে কেন্দ্র করে যেন সৃষ্টি হয়েছে বন্ধুত্বের এক নতুন ঐতিহাসিক যুগ। তাকে স্বাগত জানাতে প্রটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে নিজেই হাজির হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চমকে দেন। অকস্মাৎ মোদির এই উপস্থিতিতে বিমোহিত হন ওবামা। স্থানীয় সময় তখন সকাল পৌনে ১০টা। দিল্লির পালাম বিমানবন্দরের মাটি ছুঁয়েছে নীল-সাদা জাম্বো বিমান ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’। বিমানবন্দরসহ সারা দিল্লিতে তখন সতর্ক সবাই। নিরাপত্তা প্রহরীদের চোখ স্থির। বিমানটির দরজা খোলে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে। সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় নীল স্যুট পরা ছয় ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটি প্রিয়তম স্ত্রীর হাত ধরে বেরিয়ে এলেন। তিনি আর কেউ নন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এর আগে থেকে সবগুলো মিডিয়া, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের নিয়মিত সম্প্রচার বাদ দিয়ে ক্যামেরা ধরে রাখে বিমানবন্দরে। ওবামা বিমান থেকে বের হওয়ার আগেই সব প্রটোকল বা নিয়ম ভঙ্গ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গিয়ে হাজির হন বিমানবন্দরে। তাকে সেখানে দেখে হকচকিয়ে যান অনেকে। ওবামা বিমান থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে হাত নাড়েন উপস্থিতদের উদ্দেশে। নিচে নেমেই জড়িয়ে ধরেন নরেন্দ্র মোদিকে। সৌহার্দ, ভ্রাতৃত্বের, বন্ধুত্বের এক নতুন উদাহরণ রচনা হলো। আজ ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকছেন ওবামা। তাকে ভারত যে সম্মান দিয়েছে তা বিরল। পালম বিমানবন্দরে ওবামা-মোদি গতকাল সামান্য আলোচনার পর ছুটে যান মৌর্য শেরাটন হোটেলে। সেখানে কিছু সময় কাটান ওবামা দম্পতি। সোয়া ১২টা নাগাদ ওবামা ৪০-৫০টি গাড়ি বহর নিয়ে যান রাইসিনা হিলসে রাষ্ট্রপতি ভবনে। এখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সব সদস্য। ফোরকোর্টে ওবামার গাড়ি প্রবেশ করতেই তাকে সম্মান জানাতে ২১ বার তোপধ্বনি দেয়া হয়। এখানেই উইং কমান্ডার পুজা ঠাকুরের নেতৃত্বে তাকে দেয়া হয় গার্ড অব অনার। রাষ্ট্রপতি ভবনে ওবামাকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। প্রজাতন্ত্র দিবসের আমন্ত্রণ পেয়ে সম্মানিত বোধ করেন ওবামা। এ সময় তিনি আপ্লুত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি ভারতীয় স্টাইলে দু’হাত এক সঙ্গে মিলিয়ে সবাইকে বলেন ‘নমস্তে’। রাষ্ট্রপতি ভবনে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে ওবামার গাড়িবহর ছুটে যায় রাজঘাটে। সেখানে তিনি মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তারপর যান হায়দরাবাদ হাউজে। এখানে সবুজ খোলা প্রাঙ্গণে ওবামা-মোদি চা-চক্রে মিলিত হন। ওবামাকে নিজ হাতে চা তুলে দেন নরেন্দ্র মোদি। সেই চা পান করে ওবামার কণ্ঠে প্রশংসা ঝরে পড়ে- ‘চাই পে চর্চা’। মধ্যাহ্নভোজের পর দু’নেতা এই খোলা প্রাঙ্গণে বেরিয়ে আসেন। সেখানে রাখা ছিল দু’টি সোফা। তার প্রতিটিতে একজন করে বসা যায়। সেখানে কোন কর্মকর্তা, কর্মচারী ছিলেন না। তাই মোদি নিজে হাতে চায়ের পাত্র তুলে নেন। আরেক হাতে একটি সাদা কাপ নেন। সঙ্গে একটি পিরিচ। সেই কাপে চা ঢালেন। এরপর তা এগিয়ে ধরেন ওবামার দিকে। ওবামাও উষ্ণ হাতে তা গ্রহণ করেন। শুরু হয় দু’নেতার একান্ত আলাপচারিতা। এখানেই দীর্ঘক্ষণ তারা একান্তে আলোচনা সারেন। ততক্ষণে মিডিয়ায় বলা হয়, তারা যৌথ সংবাদ সম্মেলন করবেন। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন সংবাদ সম্মেলনে আসতে তাদের বিলম্ব হচ্ছিল তখন অনেকেই ধরে নেন- গুরুত্বপূর্ণ কোন ইস্যুতে দু’নেতা একমত হয়ে থাকতে পারেন। পরে সংবাদ সম্মেলনে তারা বললেন, ৫ বছর আগে দু’দেশের মধ্যে যে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তা বাস্তবায়নে তারা একমত হয়েছেন। এর ফলে বাণিজ্যিক রূপ পেতে যাচ্ছে এ চুক্তি। এ সময় দু’নেতার মধ্যে যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা ভাবধারা দেখা গেছে তাতে স্পষ্ট হয়েছে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফরের পরে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছে। তাদের বোঝাপড়া চমৎকার। তাদের কথা বলার ধরন ত্বরিত।
সংবাদ সম্মেলনে মোদি
হায়দরাবাদ হাউজে চা-চক্রের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বারাক ওবামা ও নরেন্দ্র মোদি। এ সময় প্রথম বক্তব্য রাখেন মোদি। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা ও ফার্স্ট লেডিকে ভারতে স্বাগত জানাতে পেরে আমরা ভীষণ আনন্দিত। আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট আপনি আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। এ দিনটি বিশেষ। কারণ এ দিন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ দু’টি গণতান্ত্রিক দেশ তাদের মূল্যবোধ শেয়ার করতে পারছে। শেষ আমাদের মধ্যে যে অগ্রগতি হয়েছিল তা নতুন করে শুরুর এটা একটি নতুন শুভ সূচনা। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের ৬ বছর পরে আমরা বাণিজ্যিক সহযোগিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রতিরক্ষা চুক্তি নতুন গতি পাচ্ছে। নৌ প্রতিরক্ষা জোরদার করতে আমাদের সহযোগিতা শক্তিশালী হবে। সন্ত্রাস এখনও রয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী হুমকি। এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে বিশ্বব্যাপী কৌশল নির্ধারণে আমরা একমত হয়েছি। সন্ত্রাস নির্মূলে প্রতিটি দেশকে তার প্রতিশ্রুতি অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এ বছরে প্যারিসে জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছি। আমরা বিশ্ব ও আঞ্চলিক ইস্যুতে আলোচনা করেছি। আফগানিস্তানে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
ওবামা যা বললেন
‘আপ সাব কো মেরা পিয়ার ভরা নমস্কার’ বলেই ওবামা তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, আমি প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দু’বার ভারত সফর করতে পেরে সম্মানিত। মিশেল ওবামা ও আমাকে যে অবিশ্বাস্য আতিথেয়তা দেয়া হয়েছে তাতে ভারতের জনগণের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ‘চাই পে চর্চা’র জন্য ধন্যবাদ। হোয়াইট হাউজে এ ধারা আরও এগিয়ে নেয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রী, আপনি নির্বাচিত হওয়া ও ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার দৃঢ় অবস্থান আমাদেরকে এই ধারায় আরও বেগবান করবে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী মোদিকে মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বলিউড তারকার মতো অভ্যর্থনা দেয়া হয়। আমাদের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব জনগণের নিত্যদিনের জীবনধারাকে উন্নত করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১০ হাজার কোটি ডলার থেকে আমাদের বাণিজ্য আরও এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতে ব্যবসাকে সহজতর করতে সংস্কার করেছেন। এজন্য তার প্রশংসা করি। পরিবেশবান্ধব শক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সমর্থন করতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছি। ভারত স্থায়ী সদস্য পদ পেতে পারে এমন এক নিরাপত্তা পরিষদকে আমরা সমর্থন করি। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা একমত হয়েছি। রাশিয়াকে দুর্বল করে দেয়ার কোন আগ্রহ আমাদের নেই। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করাই হবে আমাদের প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার।
সুজাতা সিংয়ের বক্তব্য
ওদিকে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বলেন চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল তা শেষ হয়ে গেছে। বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি, প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সাফল্য এসেছে।
ভারতে পরিবর্তিত মার্কিন নীতি
ভারতের সঙ্গে এক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল শীতল। কিন্তু ভারতের লোকসভা নির্বাচনে যখন আভাস ফুটে ওঠে যে ভারতে ক্ষমতাসীন হতে চলেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। আর সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র দামোদর মোদি। এমনই ইঙ্গিত পেয়ে মার্কিন প্রশাসন থেকে বলা হয়, গুজরাট দাঙ্গার পর তারা নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা তুলে নেয়া হবে। নির্বাচনের ফল বের হতেই নিশ্চিত হয়ে যায় নরেন্দ্র মোদি হতে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গে তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিনন্দন জানানো হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানেই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন সূচনা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এ সম্পর্ক এখন নতুন গতি পেয়েছে।