ডেস্ক: আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প করোনাভাইরাসে পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন, সবাইকে চমকে দেয়া এই খবর প্রকাশ পাবার পর তিন দিন কেটে গেছে। সেই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, হাসপাতাল থেকে হোয়াইট হাউসে ফিরে গেছেন এবং উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেরই শরীরে কোভিড শনাক্ত হবার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
কিন্তু এ পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। এইসব প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করবে এই ভাইরাস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কতটা ক্ষতি করবে? এর প্রভাব তার স্বাস্থ্য, তার সম্মান ও তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য কতটা ক্ষতিকর?
ট্রাম্প শেষ কখন করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ এসেছিলেন?
এটাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। পরপর তিনদিন ডাক্তাররা এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ায় এর উত্তরের দিকেই এখন সবার বেশি নজর।
এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন কিছু নয়। অন্তত কঠিন হবার কথা নয়। কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাওয়া থেকে একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, সরকারিভাবে যা বলা হচ্ছে – তা হয়ত সঠিক নয়।
সরকারিভাবে হোয়াইট হাউস থেকে বলা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। তার ভাইরাস পরীক্ষা পজিটিভ আসে এবং বেশি রাতে এক টুইট বার্তার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট তার পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেন।
কিন্তু ঠিক কখন তাকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং সেই পরীক্ষার ফল কী এসেছিল, সেটা জানা গেলে পরিষ্কার হবে যে হোয়াইট হাউস অথবা প্রেসিডেন্ট নিজে কোন পর্যায়ে তার অবস্থা গোপন করার কোনরকম চেষ্টা করেছিলেন কি না।
এ ব্যাপারে যেহেতু সরকারিভাবে মুখ খোলা হচ্ছে না, তাই যে প্রশ্ন দানা বাঁধছে তা হলো, প্রেসিডেন্টকে নিয়মিতভাবে করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছিল কি না, যেটা করার কথা। অথবা, এই খবর বাইরে আসার আরো আগে প্রেসিডেন্টের কোভিড শনাক্ত হয়েছিল।
এ নিয়ে জল্পনার পেছনে আরো একটা কারণ হলো, হোয়াইট হাউসের চিকিৎসক শন কনলি শনিবার বলেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রোগ শনাক্ত হয়েছে ‘৭২ ঘন্টা আগে’। সেটা হলে দাঁড়ায় ট্রাম্পের কোভিড শনাক্ত হয়েছে বুধবার অর্থাৎ মিনেসোটায় তার প্রচার সমাবেশের আগের দিন। এবং এরপর বৃহস্পতিবার তিনি মিনেসোটায় গেছেন প্রচারণা করতে।
হোয়াইট হাউস অবশ্য পরে এক বিবৃতি দিয়ে বলেছিল তার চিকিৎসক ‘ভুল বলেছিলেন’। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্টের ভাইরাস শনাক্ত হবার পর তা ‘তৃতীয় দিন’ চলছে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুক্রবার যেরকম দ্রুত ট্রাম্পের অবস্থার অবনতি হয়, যেটা ছিল তার রোগ শনাক্ত হবার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে।
এ থেকেই তাদের ধারণা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে থাকবেন আরো অনেক আগে।
আমরা কি ট্রাম্পের স্বাস্থ্য সম্পর্কে পুরো খবর জানছি?
হোয়াইট হাউস এবং প্রেসিডেন্টের চিকিৎসা দল ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে একইরকম অস্বচ্ছ চিত্র দিচ্ছে। শুক্রবার জানানো হয়েছিল, প্রেসিডেন্টের ‘মৃদু’ উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তারপর থেকে, শুক্রবারই জানানো হয়, তার ‘বেশ বেশি’ জ্বর হয়েছে, তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এবং সেজন্য তাকে অক্সিজেন সহায়তা দিতে হয়।
শনিবার, ডা. কনলি সাংবাদিকদের বলেন, প্রেসিডেন্ট ‘খুবই ভাল আছেন’ এবং তার চিকিৎসক দল তাদের শারীরিক উন্নতি নিয়ে ‘খুবই সন্তুষ্ট’।
এর অনতিবিলম্ব পরেই, প্রেসিডেন্টের স্টাফ প্রধান মার্ক মিডোস্ সাংবাদিকদের বলেন প্রেসিডেন্টের শারীরিক অবস্থা সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে তারা ‘খুবই উদ্বিগ্ন’ এবং তিনি ‘যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার পথে রয়েছেন তা পরিষ্কার নয়’।
রোববার, ডা. কনলি দুজনের এই বক্তব্যের গরমিল সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন যে, ‘আমি এমন কোন তথ্য দিতে চাইনি, যাতে তার অসুস্থতা অন্যদিকে মোড় নেয়’।
তার এই উক্তি খুবই বিস্ময়কর – কারণ চিকিৎসকরা জনগণকে যাই বলুন না কেন, এই রোগ স্বাভাবিকভাবে যেদিকে যাবার সেদিকেই যাবে। এছাড়াও আরো কিছু অস্বাভাবিক বিষয় ঘটেছে, যাতে মনে হতে পারে চিকিৎসকদের দলটি প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সত্য তথ্য দিচ্ছে না।
যেমন, রোববার ডা. কনলি বলেন প্রেসিডেন্টকে অ্যান্টিভাইরাল বিভিন্ন ওষুধের একটি মিশ্রণ দেয়া ছাড়াও তাকে স্টেরয়েড ওষুধ ডেক্সামেথাসোন দেয়া হয়েছে। ডেক্সামেথাসোন ওষুধটি কোভিড রোগীদের দেয়া হয় শুধু মাত্র রোগীর অবস্থা ‘গুরুতর এবং সঙ্কটজনক’ হয়ে উঠলে।
ডা. কনলি আরও বলেন, শনিবারও প্রেসিডেন্টের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা আবার কমে যায়। কিন্তু সেটা ঠিক কতখানি কমে গিয়েছিল তা তিনি জানাতে অস্বীকার করেন।
তার বয়স এবং তার শারীরিক বিভিন্ন অবস্থার কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য জটিলতার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। কাজেই আমেরিকান নেতাকে যে সবরকম সম্ভাব্য চিকিৎসা দেয়া হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা তাদের বিবৃতিতে যেসব তথ্য ও ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তা যদি স্বচ্ছ্ব না হয়, তাহলে জনসাধারণের আস্থা যে ধাক্কা খাবে – তাতে সন্দেহ নেই।
মাইক পেন্সের কি আইসোলেশনে যাওয়া উচিত?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কিছু হলে সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এ পর্যন্ত তার কোয়ারেন্টিনে যাবার কোনরকম সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। যেখানে তিনিও ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছেন এমন সম্ভাবনা রয়েছে।
পেন্স এবং তার স্ত্রী ক্যারেন রোববার পরীক্ষায় নেগেটিভ এসেছেন বলে জানিয়েছেন। তারা বলেছেন সেটি ছিল ওই সপ্তাহে তাদের তৃতীয়বার পরীক্ষার ফল।
তবে করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে ১৪দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। কাজেই ভাইস প্রেসিডেন্ট যে নিশ্চিতভাবে সংক্রমিত হননি এমন গ্যারান্টি এখুনি দেয়া সম্ভব নয়।
বেশ কয়েক মাস ধরেই ট্রাম্প বিষয়টা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন জন-সমাবেশে হাজির থেকেছেন এবং মাস্ক পরার বিষয়টাকে তিনি গুরুত্ব দেননি।
পেন্স এ সপ্তাহে প্রচারণা চালিয়ে যাবার যে ঘোষণা এখন দিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে ট্রাম্প ঠেকে শিখলেও, আসলেই তারা আদতেই এর থেকে কোন শিক্ষা নিচ্ছেন কি না!
কন্ট্যাক্ট ট্রেসে এত ধীর গতি কেন?
গত নয় মাসে দেখা গেছে যে, এই ভাইরাস তার নিজস্ব গতিতে কাজ করে চলেছে। এবং মানুষ – বিশেষ করে ব্যক্তিবিশেষ, সমাজ, ও সরকার যখনই সুরক্ষায় ঢিলে দিয়েছে তখনই এই ভাইরাস নিশ্চিন্তে তার থাবা বসাতে তৎপর হয়েছে।
এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত গত শনিবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে ট্রাম্প তার মনোনীত প্রার্থী হিসাবে এমি কোনি ব্যারেটের নাম ঘোষণার জন্য যে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন সেটি।
আনুষ্ঠানিকভাবে রোজ গার্ডেনে যে অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার নাম ঘোষণা করেন ট্রাম্প – সেখানে উপস্থিত ছিলেন বহু মানুষ, বিশেষ করে প্রশাসনের শীর্ষ স্থানীয় বহু ব্যক্তি।
এই অনুষ্ঠানকে রোগের ‘মহাবিস্তারের’ একটি সম্ভাব্য উৎস হিসাবে মনে করা হচ্ছে। ভিডিওতে দেখা গেছে ওই অনুষ্ঠানে অতিথিরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করছেন, কাছ থেকে কথাবর্তা বলছেন এবং কারোরই মাস্ক পরা নেই।
প্রেসিডেন্ট এবং ফার্স্ট লেডি ছাড়াও ভাইস প্রেসিডেন্টের পাশে প্রথম সারিতে যারা বসেছিলেন তাদের মধ্যে পাঁচজনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
জো বাইডেনের সাথে টিভি বিতর্কের প্রস্তুতি নিতে গত সপ্তাহে রবি, সোম এবং মঙ্গলবার, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘরের ভেতর দীর্ঘ বৈঠক করেছেন বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাথে। ওই বৈঠকগুলোতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারজনের ইতোমধ্যেই কোভিড পরীক্ষায় পজিটিভ ফল এসেছে।
শীর্ষ কর্মকর্তা ও প্রেসিডেন্টের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীরা একের পর এক পজিটিভ শনাক্ত হবার পরেও প্রশাসন মনে হচ্ছে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অর্থাৎ কারা কখন কার সংস্পর্শে এসেছিলেন সে বিষয়ে যথাযথ অনুসন্ধান চালানোর ব্যাপারে উৎসাহী নয়।
ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্র বলছে গত সপ্তাহের ওই মনোনয়ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন যারা তাদের সবার সাথে সরকারের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এখনও যোগাযোগই করেননি। অথচ ট্রাম্প প্রশাসন ও কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে প্রতিদিনই করোনা শনাক্ত হবার খবর আসছে।
এছাড়াও হোয়াইট হাউসের কর্মচারীদেরও করণীয় সম্পর্কে বা তারা নিজেরা আইসোলেশনে যাবেন কি না সে বিষয়ে স্পষ্ট কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
আমেরিকায় কোভিড-১৯এ এ পর্যন্ত মারা গেছে বিশ লাখ নয় হাজার মানুষ। এখন দেশটির নতুন করোনা হটস্পটে পরিণত হয়েছে হোয়াইট হাউসের প্রশাসনিক অন্দর মহল।
ফলে, ট্রাম্পের কোভিড পরীক্ষার দিনক্ষণ ও তার করোনা সংক্রমণের বিস্তারিত নিয়ে হোয়াইট হাউসের ‘নীরবতা’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন তৈরি করে দিয়েছে।
সূত্র : বিবিসি