কেলেঙ্কারি। ক্যাসিনো থেকে করোনা টেস্ট। অভিযান, ধরপাকড়। পত্রিকায় শিরোনাম। কিন্তু এদের মদতদাতা বা গডফাদাররা কোথায়? যথারীতি এরা থেকে যান আড়ালে, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আশা করা হয়েছিল, করোনা মানুষকে অনেকটা
বদলে দিবে। অমানবিকতার গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবেন মানুষ। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি।
করোনা টেস্ট নিয়েও প্রতারণা করতে পারেন কেউ ভাবতেও পারেননি। কিন্তু সেটাই ঘটেছে। টেস্ট না করে রিপোর্ট দিয়ে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়ার মতো বিস্ময়কর ঘটনার খবর এরইমধ্যে সবার জানা। শুধু বাংলাদেশ কেন, সারা পৃথিবীতেই এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসেও শিরোনাম হয়েছে। তাজ্জব দুনিয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজি’র পেছনে কারা রয়েছে। কারা তাদের মদতদাতা। কারা কাজ পাইয়ে দিয়েছে এই ভয়ঙ্কর প্রতারকদের, যারা মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে পারে। এই মদতদাতারা কি আড়ালেই থেকে যাবেন, তাদের কি আইনের আওতায় আনা হবে না?
রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে চলছে ‘আমি জানি না’ খেলা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রথমে এরজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়। পরে মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা চায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের কাছে। ব্যাখ্যা দেনও তিনি। তখনকার স্বাস্থ্য সচিবের নির্দেশে চুক্তির কথা জানান আজাদ। সূত্র বলছে, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় মন্ত্রণালয়। করোনা সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার মামলায় গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহেদ, জেকেজি’র চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও সিইও আরিফ চৌধুরীকে। এর আগে গ্রেপ্তারের পর র্যাবও শাহেদকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সূত্র বলছে, শাহেদ তার মদতদাতা হিসাবে বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছে। কাদের সহযোগিতায় ক্ষমতার নানা পর্যায়ে সে বিচরণ করেছে তাদের নামও প্রকাশ করেছে। কারা তার কাছ থেকে সুবিধা ভোগ করেছে তাদের অনেকের কথাও বলেছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার কথাও জানিয়েছে।
অন্যদিকে জেকেজি’র চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা ও সিইও আরিফ চৌধুরী তাদের প্রতারণার জন্য একে অপরকে দোষ দিচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তার তালাক দেয়া স্বামী আরিফ চৌধুরীকে দায়ী করছে। আর আরিফ দ্বায় চাপাচ্ছে সাবরিনার ওপর। কিন্তু কাদের মাধ্যমে জেকেজি’র মতো একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান এতবড় কাজ পেলো তা থেকে যাচ্ছে আড়ালেই। ডা. সাবরিনা এটাও দাবি করেছে, জেকেজি’র সনদ জালিয়াতির বিষয়টি এক পর্যায়ে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ফের রিমান্ডে সাবরিনা: জেকেজি’র টেস্ট জালিয়াতির ঘটনায় ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরো দুইদিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশের ৫ দিনের রিমান্ড আবেদনের ওপর শুনানি করে ঢাকার মহানগর হাকিম মাসুদ উর রহমান গতকাল ২ দিনের হেফাজত মঞ্জুর করেন। সাবরিনাকে এর আগে ৩ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। সেই রিমান্ড শেষে শুক্রবার দুপুরে তাকে আদালতে হাজির করে আরো ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদশর্ক লিয়াকত আলী। সেই আবেদনে বলা হয়, এ মামলার এক আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, সেখানে ডা. সাবরিনার নাম আসে।
রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করে সাবরিনার পক্ষে জামিনের আবেদন করেন আইনজীবী ওবায়দুল হক বাচ্চুসহ কয়েকজন। সাবরিনার আইনজীবী বলেন, পুলিশ রিমান্ড আবেদনে সাবরিনাকে জেকেজি’র চেয়ারম্যান বলেছে, যা ঠিক না। একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হতে গেলে কোম্পানির মেমোরেন্ডাম অব আটিকেল্সে তার উল্লেখ থাকতে হবে, কিন্তু তা নেই। তাছাড়া মামলার এজাহারেও তার নাম নেই। নিজেরা বাঁচার জন্য গ্রেপ্তার অন্যরা জবানবন্দিতে তাকে জড়িয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হীরন বলেন, “সাবরিনা চিকিৎসক হিসেবে সরকারি চাকরি করেও অন্যায়ভাবে একটি এনজিও মেডিকেল চালাতেন। তিনি করোনা পরীক্ষা না করে ভুয়া সার্ফিকেট ইস্যু করতেন। তার জালিয়াতির আরো তথ্য উদঘাটনের জন্য ফের তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।” শুনানি শেষে বিচারক জামিন আবেদন নাকচ করে সাবরিনাকে আরো ২ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন বলে আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এস আই ফরিদ মিয়া জানান।
৪ সুন্দরীর ফাঁদ শাহেদের: আলোচনায় এখন শাহেদের ৪ কলগার্ল। তার প্রতারণা জায়েজ করতে ব্যবহার করা হতো তাদের। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের বড় কর্তাদের মনোরঞ্জন করতে এসব কলগার্লদের পাঠাতেন তিনি। তাতেও কর্মকর্তারা ম্যানেজ না হলে কলগার্লদের সঙ্গে তাদের থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে পাঠাতেন। তাদের সমস্ত খরচ বহন করতেন শাহেদ। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে টেন্ডার, তদবির এবং বিভিন্ন কাজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে নিতেন।
সেই ৪ কলগার্লের নাম ও ঠিকানা এখন গোয়েন্দাদের হাতে। শাহেদ র্যাবের জালে আসার পরই তারা আত্মগোপনে চলে যায়। তার মধ্যে একজনকে সাময়িক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। ওই নারী তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছে যে, সে নিজেও শাহেদের ব্ল্যাকমেইলের শিকার। তার খপ্পড়ে পড়ে তিনি তার জীবন ও যৌবন সব শেষ করেছেন। তিনিও শাহেদের বিচার চেয়েছেন। এছাড়াও প্রতারক শাহেদের চোরাই মোবাইল ফোনের ব্যবসার যোগসূত্র পেয়েছে তদন্তকারীরা। তিনি দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাই মোবাইল সেট ঢাকায় এনে ঢাকার বড় বড় শপিং মলে বাজারজাত করতেন। সেই মোবাইলগুলো যাতে শুল্ক কর্মকর্তারা জব্দ করতে না পারেন এজন্য কিছু অসাধু শুল্ক কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে বাগে আনতেন তিনি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতারক শাহেদ এখন ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগ। মামলা তদন্তের মুখ্য সমন্বয়কারী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি (উত্তর) বদরুজ্জামান জিল্লু গতকাল মানবজমিনকে জানান, ‘মামলাটির তদন্ত শুরু হয়েছে।
সূত্র জানায়, শাহেদের চারজন কলগার্লের মধ্যে তিনজনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় এখন গোয়েন্দাদের হাতে। নাম ও ঠিকানা নিয়ে একজনের বিষয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। সূত্র জানায়, শাহেদের এক কলগার্ল হলেন, একজন উঠতি টিভি অভিনেত্রী। ২ বছর ধরে তার টিভি মিডিয়ায় পদচারণা। তিনি ল্যাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উঠে এসেছেন রূপালি টিভি পর্দায়। সরকারি এক অনুষ্ঠানে শাহেদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শাহেদ জানিয়েছেন। শাহেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে টিভি মিডিয়ার সংগঠন ডিরেক্টর গিল্ডসের এক নেতার বড় ভূমিকা রয়েছে।
সূত্র জানায়, আরেক কলগার্ল হচ্ছেন ঢাকার একটি পাঁচ তারকার হোটেলের ড্যান্সার। হোটেলে পার্টিতে শাহেদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এরপর থেকেই ওই নারী শাহেদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এছাড়াও উত্তরা এলাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তার কলগার্ল ছিল। লাস্যময়ী এ সুন্দরী কলগার্ল শাহেদের সঙ্গে একাধিকবার নেপাল, ভারত ও থাইল্যান্ডেও গেছে বলে শাহেদ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার করেছেন।
সূত্র জানায়, তাদের প্রত্যেকের পেছনে শাহেদের মাসে ১ লাখ টাকা খরচ হতো। এছাড়াও চার কলগার্লদের মধ্যে ওই টিভি অভিনেত্রীকে একটি প্রাইভেটকারও গিফট করেছিলেন। সেই কারটি তিনি এখনো ব্যবহার করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারের আগে তার দ্বিতীয় কলগার্লের সঙ্গে শাহেদের বনিবনা হচ্ছিল না। ওই কলগার্ল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি বড় টেন্ডার তাকে বাগিয়ে এনে দিয়েছিলেন। ওই টেন্ডার এনে দিতে পারলে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়ার কথা ছিল শাহেদের। কিন্তু, তিনি পরে তার কথা রাখতে পারেননি। এতেই ওই কলগার্ল তার ওপর ক্ষিপ্ত হন। হোটেলের ড্যান্সার ওই কলগার্ল তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন নিরাপত্তারক্ষী জানান, হাসপাতালে শাহেদের অফিসে একাধিক নারীর যাতায়াত ছিল। অনেক নারী তার খপ্পড়ে পড়ে সব হারিয়েছেন। কেউ অর্থের কারণে ব্যবহার হয়েছিলেন।