করোনা : ভোগান্তি, জালিয়াতির পর কমছে টেস্ট, কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ?

Slider জাতীয়


বাংলাদেশে শুরু থেকেই করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা নিয়ে নানামুখী বিতর্ক এখন জালিয়াতি ও ভুয়া টেস্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। ‌নানা ভোগান্তি এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষেরা বলছেন, বাধ্য না হলে অনেকেই পরীক্ষা করছেন না।

উচ্চ সংক্রমণের মধ্যে যখন পরীক্ষা বেশি হওয়ার কথা তখন জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে পরীক্ষার পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতির মধ্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষার সংখ্যা কমতে শুরু করেছে যা নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মার্চে প্রথম করোনা শনাক্তের মাসে দিনে গড়ে ৫০টিরও কম পরীক্ষা হয়েছে। এপ্রিল মাসে গড়ে প্রতিদিন পরীক্ষা হয়েছে ২,১০২টি, মে মাসে এ সংখ্যা বেড়ে ৭,৮৭৯টি এবং জুনে গড়ে দৈনিক ১৫,২৫১টি পরীক্ষা হয়েছে। জুন মাসে একদিনে সর্বোচ্চ সাড়ে আঠারো হাজার পরীক্ষারও করা হয়েছে। অথচ জুলাই মাসে পরীক্ষার সংখ্যা কমে গেছে দৈনিক প্রায় এক হাজার।

জুলাই মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে গড়ে ১৪,২৮০টি নমুনা পরীক্ষা হলেও গত সপ্তাহে দেখা গেছে একদিনে নমুনা পরীক্ষা সর্বনিম্ন ১১ হাজারের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। জুলাই মাসে টেস্ট কমলেও সংক্রমণের হার প্রায় ২৫ শতাংশের কাছাকাছি উঠেছে। অর্থাৎ ইদানীং ৪-৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করলে একজনের দেহে ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, যে শহর বা গ্রামে হাসপাতালে গিয়ে কিংবা বাড়িতে ডেকে নমুনা সংগ্রহের পরিমাণ কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেছেন, “আগে যেমন এক জায়গায় নমুনা সংগ্রহ করতে গেলে ৩০-৪০ জনেরও নমুনা নিয়ে আসা হতো পুরা বিল্ডিংয়ের। এখন আমাদের এমন কোন রিকোয়েস্টও নেই।”

“বাসা থেকে আগে যা নমুনা সংগ্রহ হতো সেটাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। কারণ মানুষ নমুনা সংগ্রহ করার জন্য ডাকছে না।”
তবে নাসিমা সুলতানার দাবি, এখন প্রয়োজন ছাড়া কেউ টেস্ট করছে না তাই সংক্রমণ হার বেশি।

“এখন যাদের প্রয়োজন তাদেরই পরীক্ষা হচ্ছে, তাই শনাক্তের হারটা বেশি। যাদের প্রয়োজন নাই তারা টেস্ট করছে না। আর এখন যেগুলো একেবারেই দরকার সেগুলোই টেস্ট হচ্ছে। আর আমরা সব বিভাগেই বিভাগীয় পরিচালকদের বলছি নমুনা সংগ্রহ কম হচ্ছে, আপনারা ড্রাইভ দেন। তারাও ড্রাইভ দিচ্ছে, বলছে যে লোক আসে না।”

টেস্ট নিয়ে যত বিতর্ক

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস টেস্ট নিয়ে বিতর্ক লেগে আছে শুরু থেকেই। প্রথমে শুধু আইইডিসিআর পরীক্ষা করার নীতি আর কম টেস্ট করা নিয়ে যে বিতর্কের শুরু সেটি ধাপে ধাপে কিট সংকট, র‍্যাপিড টেস্ট, টেস্টের জন্য ফি ধার্য থেকে টেস্ট জালিয়াতি পর্যন্ত গড়িয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, টেস্ট নিয়ে শুরু থেকেই ভুলনীতির চক্রে বাংলাদেশে আজ এ অবস্থা।

“আমরা ভুলভাবে এগিয়েছি এটা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো দরকার। একেবারে খোলনলচে পাল্টে ফেলা দরকার। আমরা সবসময় বলে আসছিলাম যে টেস্টগুলো ফ্রি করার। টেস্ট ফ্রি করলে যে সুবিধাটা হতো, এই অনিয়মগুলো হতো না। মানুষ বেশি টেস্ট করাতো যতবেশি করে টেস্ট করা যেত ততগুলো বেশি শনাক্ত হতো।”

মি. আহমেদ বলেন, “অ্যান্টিজেন টেস্ট যদি চালু করা যেত এই ঘাটতিটা পূরণ করা যেত। সেই নীতিতে সমস্যা আছে। তারমানে বহুপাক্ষিক এবং বহুমাত্রিক সমস্যার ফলে আমাদের এই টেস্টটা কমে গেছে। যেটা আমাদের জন্য আসলে একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বা আত্মঘাতী কার্যক্রমের মতো হয়েছে।”

ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভাইরাস আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে আট নম্বরে এবং এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে। ১৬ই জুলাই পর্যন্ত তথ্যে প্রতি মিলিয়নে আক্রান্তের সংখ্যা ১,১৭৫ জন। আর প্রতি মিলিয়নে টেস্ট হচ্ছে মাত্র ৬০২৯ জনের। বিশ্বে প্র্রতি মিলিয়ন মানুষের মধ্যে পরীক্ষার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮-এ। দক্ষিণ এশিয়ায় ৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৭ নম্বরে আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে পেছনে ৬ নম্বরে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্ত টেস্ট না হওয়ায় মহামারি পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণাও পাওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও তাই বেগ পেতে হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক নাসরিন ড. নাসরিন সুলতানা বলেন, “টেস্ট ছাড়া সংক্রমণ কমানো কোনভাবেই সম্ভব না। যতবেশি টেস্ট হবে তত বেশি ডিটেক্ট হবে ততবেশি আইসোলেশন হবে, কোয়ারেন্টিন হবে, এবং ততবেশি অপরকে সংক্রমিত করার সম্ভাবনা কমে যাবে।”

“এখানেতো ট্রেস করা যাচ্ছে না যে কার থেকে কোথায় যাচ্ছে। টেস্ট না করলেতো আমি ট্রেসিং করতে পারছি না।”

এখনো বিলম্বের অভিযোগ

বাংলাদেশে এখন জটিল রোগ নিয়ে হাসপাতাল ভর্তি, বিদেশ যাত্রা এবং অনেকক্ষেত্রে কর্মস্থলে যোগ দিতে মানুষকে করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ সার্টিফিকেট দিতে হচ্ছে। এরই মধ্যে সরকার সম্প্রতি করোনা পরীক্ষা করতে ২০০ টাকা এবং ৫০০ টাকা ফি নির্ধারণ করেছে।

ভুক্তভোগীদের কথায়, করোনা পরীক্ষার পুরো ব্যবস্থাটি বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জন্য সহজ করা যায়নি। ঢাকায় সামর্থ্যবানরা বেসরাকারি হাসপাতাল এবং ল্যাবের দ্বারস্থ হচ্ছেন আর অনেকেই আতঙ্কে হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছেন না। আর ঢাকার বাইরে এখনো অনেকেই পরীক্ষার ফলাফল পেতে বিলম্বের অভিযোগ করছেন।

হবিগঞ্জ জেলার টুম্পা তার মা ও বোন শরীরে লক্ষণ উপসর্গ দেখা দিলে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নমুনা দিয়ে দশদিন পর ফলাফল পান। পরীক্ষা ফলাফলে দেখা যায় টুম্পার নিজের ও তার মায়ের শরীরে করোনা পজিটিভ। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর গত তেসরা জুলাই দ্বিতীয় টেস্ট করান।

দ্বিতীয় পরীক্ষার নমুনা দিয়ে ১৫ই জুলাই পর্যন্ত ফলাফল পাননি। টুম্পা বলেন, তাদের নেগেটিভ সার্টিফিকেট পাওয়াটা খুবই প্রয়োজন।

“আম্মুতো অসুস্থ – আমরা যে প্র্রেসার মাপাবো, ফার্মেসি থেকে একজন লোক আনাবো সেতো আসছে না বাসায়। আমরা হসপিটালে যেতে পারতেছি না। ডায়েবেটিস মাপাবো তাকে নিয়ে ডায়েবেটিস হাসপাতালে যেতে পারতেছি না। কারণ সবাই জানে আমরা পজিটিভ।”

খুলনার একজন চাকরিজীবী আমিনুর রহমান জ্বরে ভুগে এ মাসের শুরুতে নমুনা পরীক্ষার জন্য দেন কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা তদবির করেও ১২দিনে জানতে পারেননি তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা।

মি. রহমান বলেন, “পরিচিত ডাক্তার, সাংবাদিক সবাইকে দিয়ে চেষ্টা করিয়েছি কিন্তু আমার রিপোর্টটা পাইনি। একবার বলা হচ্ছে যে আমার রিপোর্ট ঢাকা গেছে। আবার বলা হচ্ছে যে ঢাকা থেকে যা এসেছে তার মধ্যে আমার রিপোর্ট নাই। আমি বুঝতে পারতেছি না আমি পজিটিভ নাকি নেগেটিভ।”

এ ধরনের ভোগান্তির অভিযোগের ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মূখপাত্র আয়েশা আক্তার বলেন, শুরুর দিকে ব্যবস্থাপনায় কিছু ঝামেলা থাকলেও এখন সেটি অনেক কমেছে। অনেকক্ষেত্রে রোগীদের নাম ঠিকানা ফোন নম্বর ইমেইল অ্যাড্রেস ভুল দেয়ার কারণেও বিলম্ব হয়।

মিজ আক্তার বলেন, “ঢাকার বাইরে এখন দুই তিনদিনের মধ্যে হওয়ার কথা। ঢাকার মধ্যে সফটওয়্যার চালু হয়েছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পাচ্ছে। অতীতে ক্যাপাসিটির বাইরে বেশি নমুনা নেয়ার কারণে এ সমস্যা হয়েছে।”

“৬০ হাজারের মতো নমুনা নিয়ে একটা ব্যাকলগ তৈরি হয়েছিলি। সেগুলো আমরা ঢাকায় এনে দ্রুত রিপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করছি। আশাকরি ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান হবে।” সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *