লোমহর্ষক

Slider জাতীয়


ডেস্ক: যুদ্ধকবলিত লিবিয়ায় মিলিশিয়া ও পাচারকারীদের যৌথ হামলায়, এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশির পরিচয় মিলেছে। জীবিত ১২ জনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ সাতজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং ত্রিপোলিস্থ জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিদের মূল্যায়নে এটা মোটামুটি নিশ্চিত মুক্তিপণের জন্য তাদের ওপর বর্বর নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে তাদের প্রাণ দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ মিশনের পাঠানো রিপোর্টের বরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনও বলেছেন, ইতালি পাঠানোর জন্য প্রত্যেকে দালালকে ১০০০ ডলার করে দিয়েছে। ওই চুক্তিতে কমপক্ষে তিন মাস আগে তাদের লিবিয়ায় নেয়া হয়। কিন্তু বাড়তি অর্থের জন্য অস্ত্রধারী চক্রটি তাদের জিম্মি করে। ওই জিম্মি দশায় বচসার জেরে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ মিশন মানবজমিনকে জানিয়েছে, ঘটনাটি মরুভূমি এলাকার প্রায় নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ঘটেছে। যেখানে না ত্রিপোলি সরকারের পুরোপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে না মিলিশিয়াদের।

সূত্রমতে, প্রাথমিক রিপোর্টে নিহত ২৬ জনের ১২ জনই মাদারীপুরের। বাকিরা ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা জেলার বাসিন্দা। আহত ১১ জনের বেশিরভাগের বাড়িও উল্লিখিত চার জেলায়।
আন্তর্জাতিক মিডিয়া যা বলেছে: লিবিয়ার মিজদা শহরে এক পাচারকারীর পরিবারের হাতে ২৬ বাংলাদেশি অভিবাসী নিহত হওয়ার খবর দেয় রয়টার্স। তাতে বলা হয়, এক পাচারকারীকে হত্যার প্রতিশোধে তার পরিবার ২৬ বাংলাদেশিসহ মোট ৩০ জন অভিবাসীকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে বাকি চারজন আফ্রিকান। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১১ জন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) লিবিয়া কার্যালয়ের মুখপাত্র সাফা মেহলি জানান, আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। আহতদের সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য: এদিকে লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার পেছনে থাকা পাচারকারীদের বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়ে বাংলাদেশ কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, দুঃখজনকভাবে ২৬ জন নিহত, ১১ জন আহত হয়েছেন। পাচারকারীরা ত্রিপোলি থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে তাদের হত্যা করেছে। ধারণা করা হচ্ছে অন্য কোনো দেশে তাদের পাচার করা হচ্ছিল। পথিমধ্যে তাদের সঙ্গে কোনো ঝামেলা হওয়ায় পাচারকারীরা তাদের মেরে ফেলেছে।
দূতাবাসের পক্ষ থেকে আহতদের ঘটনাস্থলের কাছাকাছি হাসপাতাল থেকে ত্রিপোলিতে আনা হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এসব অভিবাসী মিজদা শহরের এক মানব পাচারকারী চক্রের কাছে জিম্মি ছিলেন। কোনোভাবে ওই পাচারকারী গতরাতে অভিবাসীদের হাতে খুন হন। পরে পাচারকারীর সহযোগী এবং আত্মীয়স্বজনরা জিম্মি অভিবাসীদের ক্যাম্পে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে তারা মারা যান। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বাংলাদেশিসহ ওই অভিবাসীদের মিজদা শহরের একটি জায়গায় টাকার জন্য জিম্মি করে রেখেছিল মানবপাচারকারী চক্র। এ নিয়ে একপর্যায়ে ওই চক্রের সঙ্গে মারধরের ঘটনা ঘটে অভিবাসী শ্রমিকদের। এতে এক মানবপাচারকারী মারা যায়। তারই প্রতিশোধ হিসেবে সেই মানবপাচারকারীর পরিবারের লোকজন এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এ বিষয়ে লিবিয়ার পশ্চিমা-সমর্থিত জাতীয় সরকার (জিএনএ) জানিয়েছে, মানবপাচারকারী চক্র ও অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যে বিরোধ চলে আসছিল, তার জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার বিস্তারিত: এদিকে লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে গত বৃহস্পতিবার লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মিজদাহতে (ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কি.মি. দক্ষিণে) কমপক্ষে ২৬ জন বাংলাদেশিকে লিবিয়ান মিলিশিয়া কর্তৃক গুলি করে হত্যা করার তথ্য পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দূতাবাস অনুসন্ধান শুরু করে। জানা যায়, লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী অপহরণকৃত বাংলাদেশিদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালালে ঘটনাস্থলে তারা নিহত হন। সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এক বাংলাদেশির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হলে তিনি জানান যে, তিনি একজন লিবিয়ানের আশ্রয়ে আত্মগোপনে আছেন। তিনি দূতাবাসকে আরো জানান যে, ১৫ দিন পূর্বে বেনগাজী থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে কাজের সন্ধানে মানবপাচারকারীরা তাদের ত্রিপোলিতে নিয়ে আসছিল। পথে তিনিসহ মোট ৩৮ জন বাংলাদেশি মিজদাহ শহরে নিকট লিবিয়ান মিলিশিয়া বাহিনীর একদল দুষ্কৃতকারীর হাতে জিম্মি হন। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে জিম্মিকারী কর্তৃক অমানবিক নির্যাতনের একপর্যায়ে অপহৃত ব্যক্তিবর্গ দ্বারা মূল অপহরণকারী লিবিয়ান নিহত হয়। এর প্রতিশোধ নিতে লিবিয়ান মিলিশিয়া বাহিনী তাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এতে আনুমানিক ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয় এবং আরো ১১ জন বাংলাদেশি হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে গুলিবিদ্ধ হন।
?এ সংবাদ প্রাপ্তির পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ মিজদাহ হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া, লাশগুলো মিজদাহ হাসপাতালের মর্গে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আহতদের পরবর্তীতে দূতাবাসের সহায়তায় উন্নততর চিকিৎসার জন্য ত্রিপোলিতে অবস্থিত বিভিন্ন হাসপাতালে আনা হয়েছে। গুরুতর আহত তিনজনের শরীর থেকে গুলি বের করার জন্য অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আহতদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস লিবিয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং আইওএম লিবিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখছে এবং তারা আহত ব্যক্তিদের জন্য সম্ভাব্য সহায়তা প্রদান করছেন। মিশনের কর্মকর্তাগণ আহতদের কাছ থেকে ঘটনার বিশদ বিবরণসহ নিহতদের পরিচয় জানার চেষ্টা করছেন। এ মর্মান্তিক ঘটনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের সুচিকিৎসার নিশ্চিতকরণে দূতাবাসকে ইতিমধ্যে নির্দেশনা প্রদান করেন।
বিচার চায় ঢাকা: সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেগুনবাগিচা জানায়, ইতিমধ্যে দূতাবাস লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরো ঘটনার তদন্তসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার, দোষীদের যথাযথ শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যও অনুরোধ জানিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে, লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিজদাহের সুরক্ষা বিভাগকে অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাস দ্রুততম সময়ে আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, মানবপাচারে জড়িতদের বিবরণ এবং লিবিয়ান সরকার কর্তৃক এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপের বিস্তারিত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে।

উল্লেখ্য যে, মিজদাহ শহরে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। এ অঞ্চলটি এখন দুটি শক্তিশালী পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে। কিছুদিন আগে ত্রিপোলি ভিত্তিক এবং ইউএন সমর্থিত জিএনএ সরকার এই অঞ্চলটি দখল করে নিলেও জেনারেল হাফতারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব ভিত্তিক সরকারি বাহিনী দু’দিন আগেও শহরটিতে বোমাবর্ষণ করেছে। ত্রিপোলি ভিত্তিক সরকারের এ অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। এমনকি ত্রিপোলি শহরেও বিরোধীপক্ষ মাঝেমাঝে বোমাবর্ষণ করে থাকে। দু’টি শক্তিশালী পক্ষ যুদ্ধরত থাকায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক নয়। এ কারণে অধিকাংশ দেশ তাদের দূতাবাস তিউনিসিয়াতে স্থানান্তর করলেও বাংলাদেশসহ মাত্র তিনটি দেশ তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এ প্রতিকূল অবস্থাতেও বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সকল প্রকার মানবপাচারের বিরোধী এবং মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যার ফলে বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের পরিমাণ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এ সমস্যাকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের লক্ষ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন বলেও সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *