নিরাপত্তাহীনতার অন্ধকারে দেশ, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে শৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যোগ

Slider জাতীয় বাংলার মুখোমুখি
10422086_1510958735853677_8109099253337599174_n
বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কের কোনাবাড়ী এলাকায় পিকেটারদের ছোড়া পেট্রলবোমায় তিনটি পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন ধরে যায়। এতে নষ্ট হয়ে যায় বিভিন্ন নিত্যপণ্য -বাংলার চোখবিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যানবাহনে আগুন, ভাংচুর ও বোমাবাজিসহ চলমান নানা সহিংসতায় কেঁপে উঠেছে দেশ। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে সর্বস্তরের মানুষ। সরকারি কার্যালয়, মন্ত্রী-বিচারপতির বাড়ি, দূতাবাস এলাকা ও সশস্ত্র র‌্যাব-পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলার ঘটনায় খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সদস্যরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সারাদেশের মাঠ প্রশাসন।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশব্যাপী যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান, স্পর্শকাতর জেলাগুলোতে বিজিবি মোতায়েন এবং র‌্যাব-পুলিশের টহল জোরদার করা হলেও জনমনে উদ্বেগ কাটেনি। বরং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিরোধী জোটের পাল্টাপাল্টি চ্যালেঞ্জের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সশস্ত্র অবস্থানে সহিংস-সংঘাত আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে_ এমন শঙ্কা সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন করে জেঁকে বসেছে। তাই ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কর্মজীবী মানুষ ক্রমেই তাদের দৈনন্দিন কর্মকা-ের রুটিন গুটিয়ে নিচ্ছেন। অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় ভাটা পড়েছে আমদানি ও রপ্তানিতে।
২০১৩ সালের সহিংসতায় বেশির ভাগ হামলা ও হতাহতের ঘটনা রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে ঘটলেও এবার ঢাকা মহানগরীতেই বিপুলসংখ্যক যানবাহনে অগি্নসংযোগসহ নানা ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটছে। বনানীতে দুর্বৃত্তদের চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হয়েছেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমান। বোমাবাজদের হামলায় নগরীর মগবাজারে এক প্রাইভেটকারচালক নিহত হয়েছেন। সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় ঘেরা খোদ রাজধানীতেই রাজনৈতিক সহিংসতার হিড়িক পড়ায় জনআতঙ্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
এ দিকে রাজনৈতিক সংঘাত ঠেকাতে পুলিশ ব্যস্ত হয়ে পড়ায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে বলে অভিজ্ঞজনরা আশঙ্কা করছেন। তারা ভয়াবহ এ পরিস্থিতিকে ‘অশনি সংকেত’ বলে মনে করছেন। তাদের ভাষ্য, জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারকে এখনই কঠোর হাতে গোটা পরিস্থিতিকে সামাল দিতে হবে। পাশাপাশি জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ‘জনআতঙ্ক’ যে কোনো মুহূর্তে ‘জনক্ষোভে’ রূপ নিতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত ১২ দিনে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪ জন নিহত হয়েছে। অগি্নদগ্ধ ও গুলিবিদ্ধ হয়ে অর্ধশতাধিক মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশই নিরীহ পথচারী, নারী ও শিশু। এছাড়াও দুর্বৃত্তদের ধরিয়ে দেয়া আগুনে পুড়ে গেছে দেড় শতাধিক যানবাহন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত দুই হাজার বাস-ট্রাক ও প্রাইভেটকার।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে জানান, দুর্বৃত্তরা এতটাই আকস্মিক রাস্তায় নেমে তা-ব চালাচ্ছে যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পেঁৗছানোরও সময় পাচ্ছে না। কঠোর গোপনীয়তায় তারা নাশকতার ছক তৈরি করায় গোয়েন্দারাও তা পুলিশকে আগাম জানাতে ব্যর্থ হচ্ছে। পরিস্থিতি দিনে দিনে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে আশঙ্কা করে ওই কর্মকর্তা নগরবাসীকে সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার পরামর্শ দেন। দুর্বৃত্তরা চোরাগোপ্তা হামলা চালালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী কিই-বা করতে পারে বলে মন্তব্য করেন পুলিশের ডিসি পর্যায়ের ওই কর্মকর্তা।
দেশের বিভিন্ন জেলাতেও পুলিশ একইভাবে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করায় জনমনে আতঙ্ক কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। উদ্বিগ্ন অনেকেই পরিবার-পরিজনসহ স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকছেন। জীবন-জীবিকার তাগিদে পরিবারের প্রধানরা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পর থেকে তার ঘরে ফেরার আগ পর্যন্ত অন্য সদস্যরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। রাস্তায় রাজনৈতিক তা-বের মাঝে পড়ে যে কোনো মুহূর্তে বড় অঘটন ঘটতে পারে এ আশঙ্কায় অনেকেই বুক পকেটে কিংবা গলায় কর্মস্থলের আইডি কার্ড, বাসার ঠিকানা ও ঘনিষ্ঠজনদের টেলিফোন নাম্বার রাখছেন। যাতে অন্তত পরিবারের সদস্যরা এ অঘটনের সংবাদটুকু পেতে পারে।
রাজধানীর সায়েদাবাদ-কুড়িল বিশ্বরুটের বাসচালক জাহিদুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘হরতাল না থাকলেও এখন রাস্তায় গাড়ি চালাইতে ভয় হয়। সব সময় মনে হয় এই বুঝি গ্যাঞ্জামের মদ্যি পড়লাম। কেউ মনে হয় গাড়িতে উইঠ্যা আগুন ধরাইয়্যা দিবো। তবুও পেটের দায়ে গাড়ি নিয়্যা নামতে অয়। তগো কার কতো ক্ষমতা আছে স্টেডিয়ামে টাইম দিয়্যা লইড়া দ্যাখ্যা; আমাগো হ্যার মদ্যে টানোস ক্যান।’
জাহিদুল জানান, তার অসুস্থ স্ত্রীর ওষুধ কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য ৬ জানুয়ারি গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। সায়েদাবাদের জনপথ মোড়ে পিকেটাররা তা ভাংচুর করেছে। শুধু তাতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি পরে তার ওপরও হামলা চালিয়েছে বলে জানান তিনি।
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইমাম হাসান আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার নাশকতাকারীদের সামাল দিতে পারছে না বরং একটি বিশেষ মহলকে উস্কে দিয়ে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করছে। যাতে শুধু জনমনেই উদ্বেগ বাড়নি, বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশকে নিয়ে আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা জানতে প্রতিদিনই দেশের বাইরে থেকে অনেকেই আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফোন করছে।
রাজধানীর মিরপুর, শাহবাগ, কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, রামপুরা, বিজয় সরণি, গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন দৈনিক বাংলা ও বনানীর বিভিন্ন সড়কে বিপুলসংখ্যক পথচারী এবং বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় সবাই অজানা আতঙ্ক মধ্যে রয়েছেন। তাদের ভাষ্য, মানুষ বিপদে পড়লে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর কাছে এগিয়ে যায়, কিন্তু বর্তমানে র‌্যাব-পুলিশই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। তারা কীভাবে সাধারণ মানুষের সহায়তা করবে।
জানা গেছে, শুধু সাধারণ মানুষই নয় মন্ত্রী, এমপি, বিচারক ও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ মিডিয়াকর্মীদের মাঝেও এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কায় তাদের অনেকেই কর্মস্থল থেকে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন স্থানে দুর্বৃত্তদের হামলায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জনগণের জানমালের নিরাপত্তার চেয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই বেশি ব্যস্ত রয়েছেন।
সচেতন মহলের আশঙ্কা, সুপরিকল্পিতভাবে দেশকে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে নেয়ার পাঁয়তারা চলছে। অনেকেই আবার এ পরিস্থিতির জন্য সরকারকেই দায়ী করছেন। তাদের ভাষ্য, ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলকে উস্কে দিচ্ছে; দলের নীতি-নির্ধারকরা লাগামহীন নানা বক্তব্য দিচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি বেগতিক রূপ নিচ্ছে। দেশে কোনো আশারবাণী নেই, সংযত কথাবার্তা নেই, জাতীয় অগ্রগতির কোনো নির্দেশনা নেই। দেশ ক্রমান্বয়ে বড় ধরনের সহিংসতার দিকে এগোচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবাইকে সংযত কথাবার্তা বলতে হবে। এটা সরকারকেই করতে হবে। দেশকে উন্নতি-অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে বলেও মন্তব্য করেন সুধীজনরা।
এদিকে সম্প্রতি পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ জনগণের মতো পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ডিউটি পালন থেকে শুরু করে বাসায় ফেরা, এমনকি ব্যক্তিগত কাজকর্ম করতে গিয়ে আতঙ্কে কাটছে পুলিশ সদস্যদের দিনকাল। জামায়াত-শিবির থানা-ফাঁড়িতে হামলা করতে পারে এ আশঙ্কায় ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি থানায় বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
ডিএমপির একজন ডিসি জানান, কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সব সদস্যকে বিশেষ সতর্কভাবে চলাচলেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারাদেশেই এ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠা পরিস্থিতিতে পুলিশের মনোবল যাতে ভেঙে না যায় সে জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *